পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

C? R\0 পারি না। তাহা যদি পরিতাম, তবে সেই মঙ্গলের দিক হইতে যুক্তি আকর্ষণ করিয়া শাস্ত্রের সহিত মিলাইয়া দিতাম। আগে দেখাইতাম, অমুক কাৰ্য আমাদের পক্ষে ভালো এবং অবশেষে দেখাইতাম তাহাতে আমাদের শাস্ত্রের সম্মতি আছে । সমুদ্রযাত্রার উপকারিতার পক্ষে ভূরি ভুরি প্রমাণ থােক-না কেন, যদি শাস্ত্ৰে তাহার বিরুদ্ধে একটিমাত্ৰ বচন থাকে, তবে সমস্ত প্ৰমাণ ব্যর্থ হইবে । তাহার অর্থ এই, আমাদের কাছে সত্যের অপেক্ষা বচন বড়ো, মানবের শাস্ত্রের নিকট জগদীশ্বরের শাস্ত্ৰ ব্যর্থ। । . শাস্ত্ৰই যে সকল সময়ে বলবান তাহাও নহে। অনেকে বলেন বটে, ঋষিদের এমন অমানুষিক বুদ্ধি ছিল যে, তাহারা যে-সকল বিধান দিয়াছেন, সমস্ত প্রমাণ তুচ্ছ করিয়া আমরা অন্ধবিশ্বাসের সহিত নিৰ্ভয়ে তাহা পালন করিয়া যাইতে পারি। কিন্তু সমাজে অনেক সময়েই শাস্ত্ৰবিধি ও ঋষিবাক্য র্তাহারা লঙঘন করেন এবং তখন লোকাচার ও দেশাচারের দোহাই দিয়া থাকেন । اس তাহতে এই প্ৰমাণ হয় যে শাস্ত্ৰবিধি ও ঋষিবাক্য অভ্ৰান্ত নহে। যদি অভ্রান্ত হইত, তবে লোকাচার তাহার কোনোরূপ অন্যথা করিলে লোকাচারকে দোষী করা উচিত হইত। কিন্তু দেশাচার ও লোকাচারের প্রতি যদি শাস্ত্ৰবিধি সংশোধনের ভার দেওয়া যায়, তবে শাস্ত্রের অমোঘতা আর থাকে না ; তবে স্পষ্ট মানিতে হয়, শাস্ত্রশাসন সকল কালে সকল স্থানে খাটে না । তাহা যদি না খাটিল, তবে আমাদের কর্তব্যের নিয়ামক কে । শুভবুদ্ধিও নহে, শাস্ত্ৰবাক্যও নহে। লোকাচার । কিন্তু লোকাচারকে কে পথ দেখাইবে । লোকচার যে অভ্রান্ত নহে, ইতিহাসে তাহার | শতসহস্র প্রমাণ আছে। লোকাচার যদি অভ্রান্ত হইত, তবে পথিবীতে এত বিপ্লব ঘটিত না, এত সংস্কারকের অভ্যুদয় হইত না । বিশেষত যে-লোকসমাজের মধ্যে জীবনপ্রবাহ নাই, সেখানকার জড় লোকচার। আপনাকে আপনি সংশোধন করিতে পারে না। স্রোতের জল অবিশ্রান্ত গতিবেগে নিজের দূষিত অংশ ক্রমাগত পরিহার করিতে থাকে। কিন্তু বদ্ধ জলে দোষ প্রবেশ করিলে তাহা সংশোধিত হইতে পারে না, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে থাকে । আমাদের সমাজ বদ্ধ সমাজ । একে তো আভ্যন্তরিক সহস্ৰ আইনে বদ্ধ, তাহার পরে আবার ইংরেজের আইনেও বাহির হইতে আষ্ট্রেপৃষ্টে বন্ধন পড়িয়া গেছে। সমাজসংশোধনে স্বদেশীয় রাজার । স্বাভাবিক অধিকার ছিল এবং পূর্বকালে তাহারা সে-কাজ করিতেন। কিন্তু অনধিকারী ইংরেজ আমাদের সমাজকে যে-অবস্থায় হাতে পাইয়াছে, ঠিক সেই অবস্থায় দৃঢ়ভাবে বাধিয়া রাখিয়াছে। সে নিজেও কোনো নূতন নিয়ম প্রচলিত করিতে সাহস করে না, বাহির হইতেও কোনাে নূতন নিয়মকে প্রবেশ করিতে দেয় না। কোনটা বৈধ কোনটা অবৈধ তাহা সে অন্ধভাবে নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে। এখন সমাজের কোনো সচেতন স্বাভাবিক শক্তি সহজে কোনোরূপ পরিবর্তন সাধন করিতে পারে না । এমন বাধা-সমাজের মধ্যে যদি লোকাচার মানিতে হয়, তবে একটা মৃত দেবতার পূজা করিতে হয় । সে কেবল একটা নিশ্চল নিশ্চেষ্ট জড় কঙ্কাল । সে চিন্তা করে না, অনুভব করে না, সময়ের পরিবর্তন উপলব্ধি করিতে পারে না । তাহার দক্ষিণে বামে নড়িবার শক্তি নাই। সমস্ত হতভাগ্য জাতি, তাহার সমস্ত ভক্ত উপাসক, যদি তাহার সম্মুখে পড়িয়া পলে পলে আপনার মরণব্ৰত উদযাপন করে, তথাপি সে কল্যাণপথে তিলার্ধমাত্র অঙ্গুলিনির্দেশ করিতে পারে না। የ። যাহারা শাস্ত্ৰ হইতে বিধি সংগ্ৰহ করিয়া লোকাচারকে আঘাত করিতে চেষ্টা করেন, তাহারা কী করেন । তাহারা মৃতকে মারিতে চাহেন। যাহার বেদনাবোধ নাই তাহার প্রতি অন্ত্র প্রয়োগ করেন, যে অন্ধ তাহার নিকট দীপশিখা আনয়ন করেন । অস্ত্ৰ প্ৰতিহত হয়, দীপশিখা বৃথা আলোকদান করে। তীহাদের আর-একটা কথা জানা উচিত । শাস্ত্রও এক সময়ের লোকাচার। তাহারা অন্য সময়ের বলিতে চাহেন, বহুপ্রাচীনকালে সমুদ্রযাত্রার কোনো বাধা ছিল না। বর্তমান লোকাচার বলে, তখন ছিল নী এখন আছে ; ইহার কোনো উত্তর নাই ।