পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&७२ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী উর্বর দেশে ম্যালেরিয়া ওলাউঠা প্রভৃতি যে-কোনাে ব্যাধি আসিয়াছে, ব্যাপ্ত না হইয়া ছাড়ে নাই । বিলাতি কাপড়েরও দিন আসিয়াছে; ইহাকে দেশের কোনো অংশবিশেষে পৃথকীকরণ কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। ] দীন ভারতবর্ষ যেদিন ইংলন্ডের পরিত্যক্ত ছিন্নবস্ত্ৰে ভূষিত হইয়া দাড়াইবে, তখন তাহার দৈনা কী বীভৎস বিজাতীয় মূর্তি ধারণ করবে। আজ যাহা কেবলমাত্র শোকাবহ আছে সেদিন তাহা কী নিষ্ঠুর হাস্যজনক হইয়া উঠিবে। আজ যাহা বিরল-বসনের সরল নম্রতার দ্বারা সংবৃত সেদিন তাহা জীর্ণ কোর্তার ছিদ্রপথে অর্ধবিরণের ইত্যরতায় কী নির্লজ্জভাবে দৃশ্যমান হইয়া উঠিবে। চুনাগলি যেদিন বিস্তীর্ণ হইয়া সমস্ত ভারতবর্ষকে গ্ৰাস করিতে আসিবে, সেদিন যেন ভারতবর্ষ একটি পা মাত্র অগ্রসর হইয়া তাহারই সমুদ্রের ঘাটে তাহার মলিন প্যান্টলুনের ছিন্ন প্রান্ত হইতে ভাঙা টুপির মাথাটা পর্যন্ত নীলাম্বুরাশির মধ্যে নিলীন করিয়া নারায়ণের অনন্তশয়নের অংশ লাভ করেন। কিন্তু এ হল সেন্টিমেন্ট, ভাবুকতা— প্রকৃতিস্থ কাজের লোকের মতো কথা ইহাকে বলা যায় না। ইহা সেন্টিমেন্ট বটে । মরিব তবু অপমান সহিব না, ইহাও সেন্টিমেন্ট । র্যাহারা আমাদিগকে ক্রিয়াকর্মে আমোদপ্রমোদ-সামাজিকতায় সর্বতোভাবে বাহিরে ঠেলিয়া রাখে, আমরা তাহাদিগকে পূজার উৎসবে ছেলের বিবাহে বাপের অন্ত্যেষ্টিসৎকারে ডাকিয়া আনিব না, ইহাও সেন্টিমেন্ট । বিলাতি কাপড় ইংরেজের জাতীয় গৌরবচিহ্ন বলিয়া সেই ছদ্মবেশে স্বদেশকে অপমানিত করিব না, ইহাও সেন্টিমেন্ট । এই সমস্ত সেন্টিমেন্টেই দেশের যথার্থ বল, দেশের যথার্থ গৌরব ; অর্থে নহে, রাজপদে নহে, ডাক্তারির নৈপুণ্য অথবা আইন-ব্যবসায়ের উন্নতিসাধনে নহে। আশা করিতেছি। এই সেন্টিমেন্টের কিঞ্চিৎ আভাস আছে বলিয়াই বিলাতি বেশধারীগণ অত্যন্ত অসংগত হইলেও তাঁহাদের অর্ধাঙ্গিনীদের শাড়ি রক্ষা করিয়াছেন । পুরুষেরা কর্মক্ষেত্রে কাজের সুবিধার জন্য ভাবগীেরবকে বলিদান দিতে অনেকে কুষ্ঠিত হন না। কিন্তু স্ত্রীগণ যেখানে আছেন সেখানে সৌন্দর্য এবং ভাবুকতার রাহুরূপী কর্ম আজিও আসিয়া প্রবেশ করে নাই। সেইখানে একটু ভাবরক্ষার জায়গা রহিয়াছে, সেখানে আর স্ফীতোদর গাউন আসিয়া আমাদের দেশীয় ভাবের শেষ লক্ষণটুকু গ্ৰাস করিয়া যায় নাই । সাহেবিয়ানাকেই যদি চরম গৌরবের বিষয় বলিয়া জ্ঞান করি, তাহা হইলে স্ত্রীকে বিবি না। সাজাইয়া সে-গৌরব অর্ধেক অসম্পূর্ণ থাকে। তাহা যখন সাজাই নাই, তখন শাড়িপরা স্ত্রীকে বামে বসাইয়া এ কথা প্রকাশ্যে কবুল করিতেছি যে, আমি যাহা করিয়াছি তাহা সুবিধার খাতিরে- দেখো, ভাবের খাতির রক্ষা করিয়াছি আমার ঘরের মধ্যে, আমার স্ত্রীগণের পবিত্র দেহে । কিন্তু আমরা আশঙ্কা করিতেছি, ইহাদের অনেকেই এই প্রসঙ্গে একটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর কথা বলিবেন । বলিবেন, পুরুষের উপযোগী জাতীয় পরিচ্ছদ তোমাদের আছে কোথায় যে আমরা পরিব ? ইহাকেই বলে আঘাতের উপরে অবমাননা । একে তো পরিবার বেলা ইচ্ছাসুখেই বিলাতি কাপড় পরিলেন, তাহার পর বলিবার বেলা সুর ধরিলেন যে, তোমাদের কোনো কাপড় ছিল না বলিয়াই আমাদিগকে এই বেশ ধরিতে হইয়াছে। আমরা পরের কাপড় পরিয়াছি বটে, কিন্তু তোমাদের কোনো কাপড়ই নাই- সে আরো খারাপ । 's বাঙালি সাহেবেরা ব্যঙ্গসুরে অবজ্ঞা করিয়া বলেন, তোমাদের জাতীয় পরিচ্ছদ পরিতে গেলে পারে। চটি, হাঁটুর উপরে ধুতি এবং কাঁধের উপরে একখানা চাদর পরিতে হয় ; সে আমরা কিছুতেই পরিণ না । শুনিয়া ক্ষোভে নিরুত্তর হইয়া থাকি । যদিও কাপড়ের উপর মানুষ নির্ভর করে না, মানুষের উপর কাপড় নির্ভর করে ; এবং সে হিসাথে মোটা ধুতি চাদর লেশমাত্র লজ্জাকর নহে। বিদ্যাসাগর, এক বিদ্যাসাগর নহেন, আমাদের দেশে বহুসংখ্যক মোটা চাদরধারী ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতদের সহিত গীেরবে গাতীর্ষে কোর্তাগ্রস্ত কো" বিলাতফেরতই তুলনীয় হইতে পারেন না। যে-ব্রাহ্মণের এককালে ভারতবর্ষক সভ্যতার উচ্চ শিখরে উত্তীর্ণ করিয়াছিলেন, তাহাদের বসনের একান্ত বিরলতা জগদবিখ্যাত। কিন্তু সেসকল তর্ক তুর্ণি