পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমাজ १७१ ব্যক্তি খামক দুই কান কাটিয়া বসিবে, ইহার বাহাদুরিটা কোথায় বুঝিতে পারি না। নূতন প্রয়ােজনের সঙ্গে যখন প্রথম পরিবর্তনের আরম্ভ হয়, তখন একটা অনিশ্চয়তার প্রাদুর্ভাব হইয়া থাকে । তখন কে কতদূরে যাইবে তাহার সীমা নির্দিষ্ট থাকে না। কিছুদিনের ঠেলাঠেলির পরে পরস্পর আপসে সীমানা পাকা হইয়া আসে। সেই অনিবাৰ্য অনিশ্চয়তার প্রতি দোষারোপ করিয়া যিনি পুরা নকলের দিকে যান, তিনি অত্যন্ত কুদৃষ্টান্ত দেখান। কারণ, আলস্য সংক্রামক । পরের তৈরি জিনিসের লোভে নিজের সমস্ত চেষ্টা বিসর্জন দিবার । নজির পাইলে, লোকে তাহাতে আকৃষ্ট হয় । ভুলিয়া যায়, পরের জিনিস। কখনোই আপনার করা যায় না। ভুলিয়া যায়, পরের কাপড় পরিতে হইলে, চিরকালই পরের দিকে তাকাইয়া থাকিতে হইবে। জড়ত্ব যাহার আরম্ভ, বিকার তাহার পরিণাম । আজ যদি বলি, কে অত ভাবে, তার চেয়ে বিলিতি দোকানে গিয়া একসুট অর্ডার দিয়া আসি— তবে কাল বলিব, প্যান্টলুনটা খাটাে হইয়া গেছে, কে এত হাঙ্গাম করে, ইহাতেই কাজ চলিয়া যাইবে । কাজ চলিয়া যায়। কারণ, বাঙালি-সমাজে বিলাতি কাপড়ের অসংগতির দিকে কেহ দৃষ্টিপাত করে না । সেইজন্য বিলাতফেরতদের মধ্যেও বিলাতি সাজ সম্বন্ধে ঢ়িলাভাব দেখা যায় ; সস্তার চেষ্টায় বা আলস্যের গতিকে তাহারা অনেকে এমন ভাবে বেশবিন্যাস করেন, যাহা বিধিমত অভদ্র । কেবল তাঁহাই নহে। বাঙালি বন্ধুর বাড়িতে বিবাহ প্রভৃতি শুভকর্মে বাঙালি-ভদ্রলোক সাজিয়া আসিতে তাহারা অবজ্ঞা করেন, আবার বিলাতি ভদ্রতার নিয়মে নিমন্ত্রণ সাজ পরিয়া আসিতেও আলস্য করেন। পরসজ্জা সম্বন্ধে কোনটা বিহিত, কোনটা অবিহিত, সেটা আমাদের মধ্যে প্রচলিত নাই বলিয়া তাহারা শিষ্টসমাজের বিধিবিধানের অতীত হইয়া যাইতেছেন । ইংরেজি সমাজে তাহারা সামাজিকভাবে চলিতে ফিরিতে পান না । দেশী সমাজকে তাহারা সামাজিকভাবে উপেক্ষা করিয়া থাকেন— সুতরাং তাঁহাদের সমস্ত বিধান নিজের বিধান, সুবিধার বিধান ; সে বিধানে আলস্যঔদাসীন্যকে বাধা দিবার কিছুই নাই। বিলাতের এই সকল ছাড়া-কাপড় ইহাদের পরপুরুষের গাত্রে কিরূপ বীভৎস হইয়া উঠিবে, তাহা কল্পনা করিলে লোমহর্ষণ উপস্থিত হয় । কেবল সাজসজা নহে, আচারব্যবহারে এ-সকল কথা আরো অধিক খাটে । বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেশী প্রথা হইতে র্যাহারা নিজেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন করিয়াছেন, তাহাদের আচারব্যবহারকে সদাচার-সদব্যবহারের সীমামধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিবে কিসে। যে-ইংরেজের আচার তাহারা অবলম্বন ছেদন করিয়াছেন । এঞ্জিন কাটিয়া লইলেও গাড়ি খানিকক্ষণ চলিতে পারে, বেগ একেবারে বন্ধ হয় না । বিলাতের সমাজের হিতার্থে সকল সমাজের মধ্যেই কতকগুলি কঠোর শাসন আপনি অভিব্যক্ত হইয়া উঠে। র্যাহারা স্বেচ্ছাক্রমে আত্মসমাজের ত্যাজ্যপুত্র, এবং চেষ্টাসত্ত্বেও পরিসমাজের পোষ্যপুত্র নহেন, তাহারা মুম্বই দুই সমাজের শাসন পরিত্যাগ কৰিয়া সুখক দুইবার চেষ্টা করবেন। তাহাতে কি মঙ্গল ইহাদের একরকম চলিয়া যাইবে, কিন্তু ইহাদের পুত্রপৌত্রেরা কী করিবে, এবং যাহারা নকলের নকল করে, তাহাদের কী দুরবস্থা হইবে । -܀ দেশী দরিদ্রেরও সমাজ আছে। দরিদ্র হইলেও সে ভদ্র বলিয়া গণ্য হইতে পারে । কিন্তু বিলাতি-সাজা দরিদ্রের কোথাও স্থান নাই। বাঙালি-সাহেব কেবলমাত্র ধনসম্পদ ও ক্ষমতার দ্বারা আপনাকে দুৰ্গতির উর্ধের্ব খাড়া রাখিতে পারে। ঐশ্বর্য হইতে ভ্ৰষ্ট হইবামাত্র সেই সাহেবের পুত্রটি সর্বপ্রকার আশ্রয়হীন অবমাননার মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া যায়। তখন তাহার ক্ষমতাও নাই, সমাজও নাই। তাহার নূতনলব্ধ পৈতৃক গৌরবেরও চিহ্ন নাই, চিরাগত পৈতামহক সমাজেরও অবলম্বন নাই। তখন সে কে ৷ ”