পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

»अ . )ܠܹ ݂8 ܐܰ ভালোবাসা ; আমাদের ভালোবাসা নিতান্তই আবশ্যক, তার পরে প্রাণপণ চেষ্টায় ইহজীবনে কিছুতেই আর আরামের জোগাড় হয়ে ওঠে না । । অতএব আমরা যখন বলি, আমরা যে বিবাহ করে থাকি সেটা কেবলমাত্র আধ্যাত্মিকতার প্রতি লক্ষ রেখে পািরত্রিক মুক্তিসাধনের জন্য, কথাটা খুব জাকালো শুনতে হয়। কিন্তু তবু সেটা মুখের কথা মাত্র, এবং তার প্রমাণ সংগ্ৰহ করবার জন্য আমাদের বর্তমান সমাজ পরিত্যাগ করে প্রাচীন পুঁথির পাতার মধ্যে প্রবেশপূর্বক ব্যস্তভাবে গবেষণা করে বেড়াতে হয়। প্রকৃত সত্য কথাটা হচ্ছে, ও না হলে আমাদের চলে না, আমরা থাকতে পারি নে। আমরা শুশুকের মতো কর্মতরঙ্গের মধ্যে দিগবাজি খেলে বেড়াই বটে, কিন্তু চাটু করে অমনি যখন-তখন অন্তঃপুরের মধ্যে হুস করে। হাফ ছেড়ে না এলে আমরা বাচি নে । যিনি যা-ই বলুন, সেটা পারলৌকিক সদগতির জন্যে নয় । এমন অবস্থায় আমাদের সমাজের ভালো হচ্ছে, কি মন্দ হচ্ছে, সে কথা এখানে বিচাৰ্য নয়, সে কথা নিয়ে অনেক বাদ-প্রতিবাদ হয়ে গেছে। এখানে কথা হচ্ছিল, আমাদের স্ত্রীলোকেরা সুখী কি অসুখী । আমার মনে হয় আমাদের সমাজের যেরকম গঠন, তাতে সমাজের ভালোমন্দ যা-ই হােক আমাদের স্ত্রীলোকেরা বেশ একরকম সুখে আছে। ইংরেজেরা মনে করতে পারেন লনটেনিস না খেললে এবং “বলে না নাচলে স্ত্রীলোক সুখী হয় না, কিন্তু আমাদের দেশের লোকের বিশ্বাস, ভালোবেসে এবং ভালোবাসা পেয়েই স্ত্রীলোকের প্রকৃত সুখ । তবে সেটা একটা কুসংস্কার হতেও পারে। আমাদের পরিবারে নারীহাদয় যেমন বিচিত্ৰভাবে চরিতার্থতা লাভ করে এমন ইংরেজ-পরিবারে অসম্ভব। এইজন্যে একজন ইংরেজ-মেয়ের পক্ষে চিরকুমারী হওয়া দারুণ দূরদৃষ্টতা । তাদের শূন্যহৃদয় ক্রমশ নীরস হয়ে আসে কেবল কুকুরশাবক পালন করে এবং সাধারণ-হিতার্থে সভা পোষণ ক’রে আপনাকে ব্যাপৃত রাখতে চেষ্টা করে। যেমন মৃত্যুবৎসা প্ৰসূতির সঞ্চিত স্তন্য কৃত্রিম উপায়ে নিস্ক্রান্ত করে দেওয়া তার স্বাস্থ্যের পক্ষে আবশ্যক, তেমনি যুরোপীয় চিরকুমারীর নারীহাদয়সঞ্চিত মেহরস নানা কৌশলে নিস্ফল ব্যয় করতে হয়, কিন্তু তাতে তাদের আত্মার প্রকৃত পরিতৃপ্তি হতে পারে व् ! r ইংরেজ old maid-এর সঙ্গে আমাদের বালবিধবার তুলনা বোধ হয় অন্যায় হয় না। সংখ্যায় বোধ আমাদের বিধবা যুরোপীয় চিরকুমারীর সমান হলেও প্রধান একটা বিষয়ে প্রভেদ আছে। আমাদের বিধবা নারীপ্রকৃতি কখনো শুষ্ক শূন্য পতিত থেকে অনুর্বরতা লাভের অবসর পায় না। র্তার কোল কখনো শূন্য থাকে না, বাহু দুটি কখনো অকৰ্মণ্য থাকে না, হৃদয় কখনো উদাসীন থাকে না । তিনি কখনো জননী কখনো দুহিতা কখনো সখী । এইজন্যে চিরজীবনই তিনি কোমল সরস স্নেহশীল সেবাতৎপর হয়ে থাকেন । বাড়ির শিশুরা তারই চোখের সামনে জন্মগ্রহণ করে এবং তারই কোলে কোলে বেড়ে ওঠে । বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে তার বহুকালের সুখদুঃখময় প্রীতির সখিত্ববন্ধন, বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে স্নেহভক্তিপরিহাসের বিচিত্র সম্বন্ধ ; গৃহকার্যের ভার যা স্বভাবতই মেয়েরা ভালোবাসে তাও তার অভাব নেই। এবং ওরই মধ্যে রামায়ণ মহাভারত দুটাে-একটা পুরাণ পড়বার কিংবা শোনবার সময় থাকে, এবং সন্ধ্যাবেলায় ছোটাে ছোটাে ছেলেদের কোলের কাছে টেনে নিয়ে উপকথা বলাও একটা স্নেহের কাজ বটে। বরং একজন বিবাহিত রমণীর বিড়ালশাবক এবং ময়না পোষবার প্রবৃত্তি এবং অবসর থাকে, কিন্তু বিধবাদের হাতে হৃদয়ের সেই অতিরিক্ত কোণটুকুও উদ্যবৃত্ত থাকতে প্ৰায় দেখা যায় না । এই সকল কারণে, তোমাদের যে-সকল মেয়ে প্রমোদের আবর্তে অহৰ্নিশি ঘূর্ণ্যমান কিংবা পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় প্রবৃত্ত, কিংবা দুটাে-একটা কুকুরশাবক এবং চারটে-পাঁচটা সভা কোলে করে একাকিনী কীেমাৰ্য কিংবা বৈধব্য যাপনে নিরত, তাদের চেয়ে যে আমাদের অন্তঃপুরচারিণীরা অসুখী, এ কথা আমার মনে লয় না। ভালোবাসাহীন বন্ধনহীন শূন্য স্বাধীনতা নারীর পক্ষে অতি ভয়ানক, মরুভূমির মধ্যে অপর্যাপ্ত স্বাধীনতা গৃহীলোকের পক্ষে যেমন ভীষণ শূন্য। "