পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(88 রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্বন্ধে যে-কথাটা বলছিলুম সেটা নিতান্ত অবজ্ঞার যোগ্য বলে আমার বােধ হয় না। যে-দেশে গৃহ নষ্ট হয়ে ক্রমে হােটেল বৃদ্ধি হচ্ছে ; যে-যার নিজে নিজে উপার্জন করছে এবং আপনার ঘরটি, easy chair-টি, কুকুরটি, ঘোড়াটি, বন্দুকটি, চুরাটের পাইপটি, এবং জুয়াখেলার ক্লাবটি নিয়ে নির্বিঘ্নে আরামের চেষ্টায় প্রবৃত্ত আছে সেখানে নিশ্চয়ই মেয়েদের মৌচাক ভেঙে গেছে। পূর্বে সেবক-মক্ষিকারা মধু অন্বেষণ করে চাকে সঞ্চয় করত এবং রাজীৱী-মক্ষিকারী কর্তৃত্ব করতেন, এখন স্বার্থপরগণ যে-যার নিজের নিজের চাক ভাড়া করে সকালে মধু উপার্জনপূর্বক সন্ধ্যা পর্যন্ত একাকী নিঃশেষে উপভোগ করছে। সুতরাং রানী-মক্ষিকদের এখন বেরোতে হচ্ছে, কেবলমাত্র মধুদান এবং মধুপান করবার আর সময় নেই। বর্তমান অবস্থা এখনো তাদের স্বাভাবিক হয়ে যায় নি ; এইজন্যে অনেকটা পরিমাণে অসহায়ভাবে তারা ইতস্তত ভন ভন করে বেড়াচ্ছেন। আমরা আমাদের মহারানীদের রাজত্বে বেশ আছি এবং তঁরাও আমাদের অন্তঃপুর অর্থাৎ আমাদের পারিবারিক সমাজের মৰ্মস্থানটি অধিকার করে সকল কটিকে নিয়ে বেশ সুখে আছেন। কিন্তু সম্প্রতি সমাজের নানা বিষয়ে অবস্থান্তর ঘটছে। দেশের আর্থিক অবস্থার এমন পরিবর্তন হয়েছে যে, জীবনযাত্রার প্রণালী স্বতই ভিন্ন আকার ধারণ করছে এবং সেই সূত্রে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার কালক্রমে কথঞ্চিৎ বিশ্লিষ্ট হবার মতো বোধ হচ্ছে । সেইসঙ্গে ক্রমশ আমাদের স্ত্রীলোকদের অবস্থাপরিবর্তন আবশ্যক এবং অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। কেবলমাত্র গৃহলুষ্ঠিত কোমল হৃদয়রাশি হয়ে থাকলে চলবে না, মেরুদণ্ডের উপর ভর করে উন্নত উৎসাহী ভাবে স্বামীর পার্শ্বচারিণী হতে হবে। অতএব স্ত্রীশিক্ষা প্ৰচলিত না হলে বর্তমান শিক্ষিতসমাজে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সামঞ্জস্য নষ্ট হয় । আমাদের দেশে বিদেশী শিক্ষা প্রচলিত হওয়াতে, ইংরেজি যে জানে এবং ইংরেজি যে জানে না তাদের মধ্যে একটা জাতিভেদের মতো দাড়াচ্ছে, অতএব অধিকাংশ স্থলেই আমাদের বরকন্যার মধ্যে যথার্থ অসবর্ণ বিবাহ হচ্ছে । একজনের চিন্তা, চিন্তার ভাষা, বিশ্বাস এবং কাজ আর-একজনের সঙ্গে বিস্তর বিভিন্ন | এইজন্যে আমাদের আধুনিক দাম্পত্যে অনেক প্রহসন এবং সম্ভবত অনেক ট্র্যাজেডিও ঘটে থাকে। স্বামী যেখানে ঝাঝালো সোডাওআটার চায়, স্ত্রী সেখানে সুশীতল ডাবের জল এনে উপস্থিত করে । এইজন্যে সমাজে স্ত্রীশিক্ষা ক্রমশই প্রচলিত হচ্ছে ; কারও বক্তৃতায় নয়, কর্তব্যজ্ঞানে নয়, আবশ্যকের বশে । ܝ এখন, অন্তরে বাহিরে এই ইংরেজি শিক্ষা প্ৰবেশ করে সমাজের অনেক ভাবান্তর উপস্থিত করবেই সন্দেহ নেই। কিন্তু র্যারা আশঙ্কা করেন আমরা এই শিক্ষার প্রভাবে যুরোপীয় সভ্যতার মধ্যে প্ৰাচ্যলীলা সংবরণ করে পরম পাশ্চাত্যলোক লাভ করব, আমার আশা এবং আমার বিশ্বাস তাদের সে আশঙ্কা ব্যর্থ হবে । । কারণ, যেমন শিক্ষাই পাই-না কেন, আমাদের একেবারে রূপান্তর হওয়া অসম্ভব । ইংরেজি শিক্ষা আমাদের কেবল কতকগুলি ভাব এনে দিতে পারে। কিন্তু তার সমস্ত অনুকুল অবস্থা এনে দিতে পারে না। ইংরেজি সাহিত্য পেতে পারি। কিন্তু ইংলন্ড পাব কোথা থেকে । বীজ পাওয়া যায়। কিন্তু মাটি পাওয়াই কঠিন । । ቅዋና দৃষ্টান্তস্বরূপে দেখানাে যেতে পারে, বাইবল যদিও বহুকাল হতে যুরোপের প্রধান শিক্ষার গ্রন্থ, তথাপি য়ুরোপ আপন অসহিষ্ণু দুৰ্দান্ত ভাব রক্ষা করে এসেছে, বাইবেলের ক্ষমা এবং নম্রতা এখনো তাদের অন্তরকে গলাতে পারে নি । আমার তো বোধ হয়। য়ুরোপের পরম সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, য়ুরোপ বাল্যকাল হতে। এমন একটি শিক্ষা পাচ্ছে যা তার প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুযায়ী নয়, যা তার সহজ স্বভাবের কাছে নূতন অধিকার এনে দিচ্ছে, এবং সর্বদা সংঘাতের দ্বারা তাকে মহন্ত্রের পথে জাগ্রত করে রাখছে । য়ুরোপ কেবল যদি নিজের প্রকৃতি-অনুসারিণী শিক্ষা লাভ করত তা হলে য়ুরোপের আজ এমন উন্নতি হত না । তা হলে যুরোপের সভ্যতার মধ্যে এমন ব্যাপ্তি থাকত না, তা হলে একই উদারক্ষেত্রে