পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

» G 8. আশা করি আমরা নানা ভ্ৰম এবং নানা আঘাত-প্ৰতিঘাতের মধ্যে দিয়ে সেই পূৰ্ণ মনুষ্যত্বের দিকেই যাচ্ছি। এখনো আমরা দুই বিপরীত শক্তির মধ্যে দোদুল্যমান ; তাই উভয় পক্ষের সত্যকেই অমিশ্চিত ছায়ার মতো অস্পষ্ট দেখাচ্ছে ; কেবল মাঝে মাঝে ক্ষণেকের জন্য মধ্য আশ্রয়টি উপলব্ধি করে ভবিষ্যতের পক্ষে একটা স্থির আশা-ভরসা জন্মে। আমার এই অসংলগ্ন অসম্পূর্ণ রচনায় পৰ্যায়ক্রমে সেই আশা ও আশঙ্কার কথা ব্যক্ত হয়েছে । , `ა პაპახr অযোগ্য ভক্তি । যাহা হতে সর্বস্থিত শুধু হাতে প্ৰণামেতে ভার হয়ে যান তাতে মুখে হাসি অন্তরে বেজার। তিন টাকা নগদে দিলে চরণ তুলি মাথা পরে প্ৰসন্ন বদনে দেন বর। । উল্লিখিত শ্লোক তিনটি টাকা সম্বন্ধীয় একটি ছড়া হইতে উদধূত করিয়া দিলাম। ইহার ছন্দ মিল এবং কবিত্ব সম্বন্ধে আমি কোনো জবাবদিহি স্বীকার করিতে প্ৰস্তুত নই ৷ কেবল দেখিবার বিষয় এই যে, ইহার মধ্যে যে-সত্যটুকু বৰ্ণিত হইয়াছে তাহা আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে প্রচলিত, তাহা সর্ববাদিসম্মত । টাকার যে কী,আশ্চর্য ক্ষমতা তাহারই অনেকগুলি দৃষ্টান্তের মধ্যে আমাদের অখ্যাতনামা কবি উপরের দৃষ্টান্তটিও নিবিষ্ট করিয়াছেন । কিন্তু এ দৃষ্টান্তে টাকার ক্ষমতা অপেক্ষা মানুষের মনের সেই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা প্ৰকাশ করিতেছে যাহার প্রভাবে সে একই সময়ে একই লোককে যুগপৎ ভক্তি এবং অশ্রদ্ধা করিতে পারে । সাধারণত গুরুপুরোহিত যে সাধুপুরুষ নহেন, সামান্য বৈষয়িকদের মতো পয়সার প্রতি র্তাহার যে বিলক্ষণ লোভ আছে সে সম্বন্ধে আমাদের কিছুমাত্র অন্ধতা নাই, তথাপি তাহার পায়ের ধূলা মাথায় । লইয়া আমরা কৃতাৰ্থ হইয়া থাকি কেননা গুরু ব্ৰহ্ম। এরূপ ভক্তি দ্বারা আমরা যে নিজেকে অপমানিত করি, এবং উপযুক্ত ব্যক্তিকে সম্মান করাই যে আত্মসম্মান এ কথা আমরা মনেই করি না। কিন্তু অন্ধ ভক্তি অন্ধ মানুষের মতো অভ্যাসের পথ দিয়া অনায়াসে চলিয়া যায়। সকল দেশেই ইহার নজির আছে। বিলাতে একজন লর্ডের ছেলে সর্বতোভাবে অপদার্থ হইলেও অতি সহজেই যোগ্য লোকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়া থাকে । ч. ভক্তিজনক গুণ বা ক্ষমতাবিচারের প্রয়োজনই হয় না। এমন-কি, সে-স্থলে অভক্তির প্রত্যক্ষ কারণ " থাকিলেও তাহার পদমূলে অর্ঘ্য আপনি আসিয়া আকৃষ্ট হয়। . . এইরূপ আমাদের মনের মধ্যে স্বভাবতই অনেকটা পরিমাণে জড়ধর্ম আছে। সেই কারণে আমাদের মন অভ্যাসের গড়ানো পথে মোহের আকর্ষণে আপনিই পাথরের মতো গড়াইয়া পড়ে, যুক্তি তাহার মাঝখানে বাধা দিতে আসিলে যুক্তি চূৰ্ণ হইয়া যায়। সভ্যতার মধ্যে সেই জাগ্ৰত শক্তি আছে যাহা আমাদের মনের স্বাভাবিক জড়িত্বের বিরুদ্ধে ।