পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(* (S রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী র্তাহার স্বাভাবিক আদর্শ অপেক্ষা কতকটা পরিমাণে আপনি বাড়িয়া যায় সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহা হইতে স্বতন্ত্র হইতে পারে না । অস্থানে ভক্তি করিবার একটা মহৎ পাপ এই যে, যিনি যথার্থ পূজ্য, অযোগ্য পাত্রদের সহিত র্তাহাকে একাসনভুক্ত করিয়া দেওয়া হয় । দেবতায় উপদেবতায় প্রভেদ থাকে না । আমাদের দেশে এই অন্যায় মিশ্রণ সকল দিকেই ঘটিয়াছে। আমাদের দেশে অনাচার এবং পাপ এক কোঠায় পড়িয়া গেছে। ইতর জাতিকে স্পর্শ করাও পাপ, ইতর জাতিকে হত্যা করাও পাপ । নরহত্যা করিয়া সমাজে নিষ্কৃতি আছে কিন্তু গোহত্যিা করিয়া নিষ্কৃতি নাই। অন্যায় করিয়া যবনের অন্ন মারিলে ক্ষমা আছে কিন্তু তাহার অন্ন গ্ৰহণ করিলে পাতক । - প্ৰায়শ্চিত্ত-বিধিও তেমনি । তুিলক রাজদ্রোহ অভিযোগে জেলে গিয়াছেন— সেখানে অনিবাৰ্য রাজদণ্ডের বিধানে তাহাকে দূষিত অন্ন গ্রহণ করিতে হইয়াছে ; মাথা মুড়াইয়া গোফ কামাইয়া কঠিন প্ৰায়শ্চিত্ত বিধানের জন্য সমাজ তাহাকে আহবান করিতেছে। তিলক যে সত্য রাজদ্রোহী এ কথা কেহ বিশ্বাস করে না এবং যদি-বা করিত সেজন্য র্তাহাকে দণ্ডনীয় করিত না— কিন্তু যে অনিচ্ছাকৃত অনাচারে তাহার সাধু চরিত্রকে কিছুমাত্র স্পর্শ করে নাই তাঁহাই তাহার পক্ষে পাপ, এবং সে পাপের প্ৰায়শ্চিত্ত মস্তকমুণ্ডন ।। যে-সমস্ত পাপ অনাচার মাত্র নহে-যাহা মিথ্যাচরণ, চৌর্য, নিষ্ঠুরতা প্রভৃতি চরিত্রের মূলগত পাপ তাহারও খণ্ডন তিথিবিশেষে গঙ্গাস্নানে তীর্থযাত্রায় । অনাচার আচারের ত্রুটি এবং ধর্মনিয়মের লঙঘনকে একত্র মিশ্রিত করিয়া আমরা এমনই একটি ঘোরতর জড়বাদ, এমনই নিগুঢ় নাস্তিকতায় উপনীত হইয়াছি। ভক্তিরাজ্যেও সেইরূপ মিশ্রণ ঘটাইয়া আমরা ভক্তির আধ্যাত্মিকতা নষ্ট করিয়াছি । সেইজন্যই আমরা বরঞ্চ সাধু শূদ্ৰকে ভক্তি করি না, কিন্তু অসাধু ব্ৰাহ্মণকে ভক্তি করি। আমরা প্রভাতসূর্যালোকিত হিমাদ্রিশিখরের প্রতি দৃকপাত না করিয়া চলিয়া যাইতে পারি। কিন্তু সিন্দূরলিপ্ত উপলখণ্ডকে উপেক্ষা করিতে পারি না । । সত্য এবং শাস্ত্রের মধ্যেও আমরা এইরূপ একটা জটা পাকাইয়াছি। সমুদ্রযাত্রা উচিত কি না তাহা নির্ণয় করিতে ইহাই দেখা কর্তব্য যে, নূতন দেশ ও নূতন আচার ব্যবহার দেখিয়া আমাদের জ্ঞানের বিস্তার হয় কি না, আমাদের সংকীর্ণতা দূর হয় কি না, ভূখণ্ডের একটি ক্ষুদ্র সীমার মধ্যে কোনাে জ্ঞানপিপাসু উন্নতি-ইচ্ছুক ব্যক্তিকে বলপূর্বক বদ্ধ করিয়া রাখিবার ন্যায্য অধিকার কাহারও আছে কি না । কিন্তু তাহা না দেখিয়া আমরা দেখিব, পরাশর সমুদ্র পার হইতে বলিয়াছেন কি না এবং অত্রি কী বলিয়া তাহার সমর্থনা করিয়াছেন । বাল্যবিধবাকে চিরকুমারী করিয়া রাখা ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে নিদারুণ ও সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক কি না ইহা আমাদের দ্রষ্টব্য বিষয় নহে। কিন্তু বহু প্ৰাচীনকালে সমাজের শিক্ষা আচার ও অবস্থার একান্ত পার্থক্যের সময় কোন বিধানকর্তা কী বলিয়াছেন তাঁহাই আলোচ্য। এমন বিপরীত বিকৃতি কেন ঘটিল। ইহার প্রধান কারণ এই যে, স্বাধীনতাতেই যে-সমস্ত প্রবৃত্তির প্রধান গৌরব তাহাদিগকেই বন্ধনে বদ্ধ করা হইয়াছে । অভ্যাস বা পরের নির্দেশাবশত নহে, পরন্তু স্বাধীন বোধশক্তি যোগে ভক্তিবলে আমরা মহত্ত্বের নিকট আত্মসমপণ করি, তাহাই সার্থক ভক্তি । কিন্তু আশঙ্কা এই যে, যদি বোধশক্তি তোমার না থাকে। অতএব নিয়ম বাধিয়া দেওয়া গেল, অমুক সম্প্রদায়কে এই প্ৰণালীতে ভক্তি করিতেই হইবে । না করিলে সাংসারিক ক্ষতি ও পুরুষানুক্রমে নরকবাস । যে-ভক্তি স্বাধীন হৃদয়ের তাহাকে মৃত শাস্ত্রে রাখা হইল ; যে-ভক্তির প্রকৃত লাভ-ক্ষতি আমাদের মুক্তরােল আমাদের অন্তরাষায় তাহা সংসারের খাতায় ও চিত্রগুপ্তের কাল্পনিক খতিয়ানে লিখি " .