পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শিক্ষা ○ br> তোমরা যদি এই বিদ্যাভবনের জন্য গৌরব অনুভব কর তবেই ইহার গৌরববৃদ্ধি হইবে । বড়ো বাড়ি, মন্ত জমি বা বৃহৎ আয়োজন ইহার গৌরব নাহে ; তোমাদের শ্রদ্ধা, তোমাদের নিষ্ঠা, বাঙালির আত্মসমর্পণে ইহার গৌরব । বাঙালির ইচ্ছায় ইহার সৃষ্টি, বাঙালির নিষ্ঠায় ইহার রক্ষা— ইহাই ইহার গৌরব এবং এই গৌরবই আমাদের গৌরব । আমাদের অন্তঃকরণে যতক্ষণ পর্যন্ত গৌরববোধ না জন্মে। ততক্ষণ কেবলই অন্যের সঙ্গে আমাদের অনুষ্ঠানের তুলনা করিয়া আমরা পদে পদে লজ্জিত ও হতাশ হইতে থাকি। ততক্ষণ আমাদের বিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য দেশের বিদ্যালয় মিলাইয়া দেখিবার প্রবৃত্তি হয়- যেটুকু মেলে সেইটুকুতেই গর্ববোধ করি, যেটুকু না মেলে। সেইটুকুতেই খাটাে হইয়া যাই । কিন্তু এরূপ তুলনা কেবল নিজীব পদার্থ সম্বন্ধেই খাটে । গজকাঠিতে বা ওজনের বাটখারায় জীবিতবস্তুর পরিমাপ হয় না । আজ আমাদের দেশে এই-যে জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে, আমি বলিতেছি, ইহা নিজীব ব্যাপার নহে— আমরা প্ৰাণ দিয়া প্ৰাণ সৃষ্টি করিয়াছি। সুতরাং যেখানে ইহাকে দাড় করানো হইল সেইখানেই ইহার শেষ নহে— ইহা বাড়িবে, ইহা চলিবে, ইহার মধ্যে বিপুল ভবিষ্যৎ রহিয়াছে, তাহার ওজন কে করিতে পারে । যে-কোনো বাঙালি নিজের প্রাণের মধ্যে এই বিদ্যালয়ের প্রাণ অনুভব করিবে সে কোনোমতেই ইটকাঠের দরে ইহার মূল্যনিরূপণ করিবে না— সে ইহার প্রথম আরম্ভের মধ্যে চরম পরিণামের মহতী সম্পূর্ণতা অনুভব করিবে, সেই ইহার ব্যক্ত ও অব্যক্ত সমস্তটাকে এক করিয়া সজীবসত্যের সেই সমগ্ৰমূর্তির নিকট আনন্দের সহিত আত্মসমর্পণ করিবে । তাই আজ আমি ছাত্ৰাদিগকে অনুরোধ করিতেছি, এই বিদ্যালয়ের প্রাণকে অনুভব করে- সমস্ত বাঙালিজাতির প্রাণের সঙ্গে এই বিদ্যালয়ের যে প্ৰাণের যোগ হইয়াছে তাহা নিজের অন্তঃকরণের মধ্যে উপলব্ধি করো— ইহাকে কোনোদিন একটা ইস্কুলমাত্ৰ বলিয়া ভ্ৰম করিয়ো না । তোমাদের উপরে এই একটি মহৎ দায়িত্ব রহিল। স্বদেশের একটি. পরামধনের রক্ষণভার আজ তোমাদের উপরে যতটা পরিমাণে ন্যস্ত হইল, তোমাদিগকে একান্ত ভক্তির সহিত, নম্রতার সহিত তাহা বুঝিয়া লইতে হইবে। ইহাতে তপস্যার প্রয়ােজন হইবে। ইতিপূর্বে অন্য কোনাে বিদ্যালয় তােমাদের কাছে এত কঠোরতা দাবি করিতে পারে নাই। এই বিদ্যালয় হইতে কোনো সহজ সুবিধা আশা করিয়া ইহাকে ছোটাে হইতে দিয়ে না। বিপুল চেষ্টার দ্বারা ইহাকে তোমাদের মস্তকের উর্ধের্ব তুলিয়া ধরে ; ইহার ক্লেশসাধ্য আদর্শকে মহত্তম করিয়া রাখে ; ইহাকে কেহ যেন লজ্জা না দেয়, উপহাস করিতে না পারে, সকলেই যেন স্বীকার করে যে, আমরা শৈথিল্যকে প্রশ্রয় দিবার জন্য, জড়ত্বকে সম্মানিত করিবার জন্য বড়ো নাম দিয়া একটা কৌশল অবলম্বন করি নাই। তোমাদিগকে পূর্বাপেক্ষা যে দুরূহতার প্রয়াস, যে কঠিনতর সংযম আশ্রয় করিতে হইবে, তাহা ব্ৰতস্বরূপ ধর্মস্বরূপ গ্ৰহণ করিয়ো । কারণ, এ বিদ্যালয় তোমাদিগকে বাহিরের কোনো শাসনের দ্বারা, কোনো প্রলোভনের দ্বারা আবদ্ধ করিতে পরিবে নাইহার বিধানকে অগ্রাহ্য করিলে তোমরা কোনো পদ বা পদবীর ভরসা হইতে ভ্ৰষ্ট হইবে না- কেবল তোমাদের স্বদেশকে তোমাদের ধর্মকে শিরোধার্য করিয়া, স্বজাতির গীেরব এবং নিজের চরিত্রের সম্মানকে নিয়ত স্মরণ রাখিয়া, তোমাদিগকে এই বিদ্যালয়ের সমস্ত কঠিন ব্যবস্থা স্বেচ্ছাপূর্বক অনুদ্ধত আত্মোৎসর্গের সহিত নতশিরে বহন করিতে হইবে । আমাদের এই বিদ্যালয় সম্বন্ধে যখন চিন্তা করিবে, তখন এই কথা ভাবিয়া দেখিয়ে যে, যে-দেশে, জলাশয় নাই সে-দেশে আকাশের বৃষ্টিপাত ব্যর্থ হইয়া যায়। জল ধরিবার স্থান না থাকিলে বৃষ্টিধারার অধিকাংশ ব্যবহার নষ্ট হইতে থাকে । আমাদের দেশে যে জ্ঞানী গুণী ক্ষমতাসম্পন্ন লোক জন্মগ্রহণ করেন না। তাহা নহে— কিন্তু তাহাদের জ্ঞান গুণ ও ক্ষমতা ধরিয়া রাখিবার কোনো ব্যবস্থা আমাদের সামৰ্থ্য দেশের উপর দিয়া গড়াইয়া বহিয়া উবিয়া চলিয়া যাইতেছে । ইহা আমরা নিশ্চয় জানি,