পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO O ጃ রবীন্দ্র-রচনাবলী ডেপুটম্যাজিষ্ট্রেট হইয়া সমস্ত বিদ্যা আইন-আদালতের অতলস্পর্শ নিরর্থকতার মধ্যে চিরদিনের মতো বিসর্জন করিতে সকলে ব্যগ্র এবং কতকগুলা পাস করিয়া কেবল হতভাগা কন্যার পিতাকে ঋণের পঙ্কে ডুবাইয়া মারাই তাঁহাদের একমাত্র স্থায়ী কীর্তি হইয়া থাকে। দেশে বড়ো বড়ো শিক্ষিত উকিল-জজ-কেরানীর অভাব নাই, কিন্তু জ্ঞানতপস্বী কোথায় । কথায় কথায় কথা অনেক বাড়িয়া গেল। উপস্থিতমত আমার যেটুকু বক্তব্য সে এই বইপড়াটাই যে শেখা, ছেলেদের মনে এই অন্ধসংস্কার যেন জন্মিতে দেওয়া না হয়। প্রকৃতির অক্ষয়ভাণ্ডার হইতেই যে বইয়ের সঞ্চয় আহরিত হইয়াছে, অন্তত হওয়া উচিত এবং সেখানে যে আমাদেরও অধিকার আছে, এ কথা পদে পদে জানানো চাই। বইয়ের দৌরাত্ম্য অত্যন্ত বেশি হইয়াছে বলিয়াই বেশি করিয়া জানানো চাই। এ দেশে অতি পুরাকালে যখন লিপি প্রচলিত ছিল তখনো তপোবনে পুঁথিব্যবহার হয় নাই। তখনো গুরু শিষ্যকে মুখে মুখেই শিক্ষা দিতেন, এবং ছাত্র তাহা খাতায় নহে, মনের মধ্যেই লিখিয়া লইত। এমনি করিয়া এক দীপশিখা হইতে আর-এক দীপশিখা জ্বলিত। এখন ঠিক এমনটি হইতে পারে না । কিন্তু যথাসম্ভব ছাত্ৰাদিগকে পুঁথির আক্রমণ হইতে রক্ষা করিতে হইবে। পারতপক্ষে ছাত্ৰাদিগকে পরের রচনা পড়িতে দেওয়া নহে- তাহারা গুরুর কাছে যাহা শিখিবে, তাহদের নিজেকে দিয়া তাহাই রচনা করিয়া লইতে হইবে ; এই স্বরচিত গ্ৰন্থই তাহদের গ্রন্থ । এমন হইলে তাহারা মনেও করিবে না, গ্রন্থগুলা আকাশ হইতে পড়া বেদবাক্য । “আর্যরা মধ্য-এশিয়া হইতে ভারতে আসিয়াছেন, “খুচুস্টজন্মের দুই হাজার বৎসর পূর্বে বেদ রচনা হইয়াছে, এই সকল কথা আমরা বই হইতে পড়িয়াছি- বইয়ের অক্ষরগুলো কাটকুটিহীন নির্বিকার ; তাহারা শিশুবয়সে আমাদের উপরে সম্মোহন প্রয়োগ করে- তাই আমাদের কাছে আজ। এ-সমস্ত কথা একেবারে দৈববাণীর মতো । ছেলেদের প্রথম হইতেই জানাইতে হইবে, এই সকল আনুমানিক কথা কতকগুলা যুক্তির উপর নির্ভর করিতেছে। সেই সকল যুক্তির মূল উপকরণগুলি যথাসম্ভব তাঁহাদের সম্মুখে ধরিয়া তাঁহাদের নিজেদের অনুমানশক্তির উদ্রেক করিতে হইবে। বইগুলা যে কী করিয়া তৈরি হইতে থাকে তাহা প্রথম হইতেই অল্পে অল্পে ক্রমে ক্রমে তাহারা নিজেদের মনের মধ্যে অনুভব করিতে থাকুক ; তাহা হইলেই বইয়ের যথার্থ ফল। তাহারা পাইবে, অথচ তাহার অন্ধশাসন হইতে মুক্তিলাভ করিতে পরিবে, এবং নিজের স্বাধীন উদ্যমের দ্বারা জ্ঞানলাভ করিবার যে স্বাভাবিক মানসিক শক্তি, তাহা ঘাড়ের-উপরে-বাহির-হইতে-বোঝা-চাপানো বিদ্যার দ্বারায় আচ্ছন্ন ও অভিভূত হইবে না- বইগুলোর উপরে মনের কর্তৃত্ব অক্ষুধা থাকিবে । বালক অল্পমাত্রও যেটুকু শিখিবে, তখনই তাহা প্রয়োগ করিতে শিখিবে ; তাহা হইলে শিক্ষা তাহার উপরে চাপিয়া বসিবে না, শিক্ষার উপর সে-ই চাপিয়া বসিবে। এ কথায় সায় দিয়া যাইতে অনেকে দ্বিধা করেন না, কিন্তু কাজে লাগাইবার বেলা আপত্তি করেন। তাহারা মনে করেন, বালকদিগকে এমন করিয়া শিক্ষা দেওয়া অসম্ভব। র্তাহারা যাহাকে শিক্ষা বলেন, তাহা এমন করিয়া দেওয়া অসম্ভব বটে। র্তাহারা কতকগুলা বই ও কতকগুলা বিষয় বাধিয়া দেন-নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট প্ৰণালীতে তাহার পরীক্ষা লওয়া হয়- ইহাকেই তাহারা বিদ্যাশিক্ষা-দেওয়া বলেন এবং যেখানে সেইরূপ শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহাকেই বিদ্যালয় বলা হয়। বিদ্যা জিনিসটা যেন একটা স্বতন্ত্র পদার্থ ; শিশুর মন হইতে সেটাকে যেন তফাত করিয়া দেখিতে হয় ; সেটা যেন বইয়ের পাতা এবং অক্ষরের সংখ্যা, তাহাতে ছাত্রের মন যদি পিষিয়া যায়, সে যদি পুঁথির গোলাম হয়, তাহার স্বাভাবিক বুদ্ধি যদি অভিভূত হইয়া পড়ে, সে যদি নিজের প্রাকৃতিক ক্ষমতাগুলি চালনা করিয়া জ্ঞান অধিকার করিবার শক্তি অনভ্যাস ও উৎপীড়ন –বশত চিরকালের মতো হারায়, তবু ইহা বিদ্যাকারণ ইহা এতটুকু ইতিহাসের অংশ, এতগুলি ভুগোলের পাতা, এত কটা অঙ্ক, এবং এতটা পরিমাণ বি-এল-এ রে, সি-এল-এ ক্লে ! শিশুর মন যতটুকু শিক্ষার উপরে সম্পূর্ণ কর্তৃত্বলাভ করিতে পারে, অল্প হইলেও সেইটুকু শিক্ষাই শিক্ষা ; আর যাহা শিক্ষানাম ধরিয়া তাহার মনকে আচ্ছন্ন করিয়া দেয় তাহাকে পড়ানো বলিতে পারো, কিন্তু তাহা শেখানো নহে। মানুষের পরে মানুষ অনেক অত্যাচার্চ করিবে জানিয়াই বিধাতা তাহাকে শক্ত করিয়া গড়িয়াছেন ; সেইজন্য গুরুপাক অখাদ্য খাইয়া অজীর্ণ