পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VSO রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু একারের বিকার কোথায় হইবে তাহার একটা নিশ্চিত নিয়ম বাহির করা এমন সহজ নহে; অনেক স্থলে দেখা যায় অবিকল একইরূপ প্রয়োগে ‘এ’ কোথাও বা বিকৃত কোথাও বা অবিকৃত ভাবে আছে ; যথা, তোলা (তৈলাক্ত) এবং বেলা (সময়) । প্রথমে দেখা যাক, পরে অকারান্ত অথবা বিসর্গ শব্দ থাকিলে পূর্ববর্তী একারের কিরূপ অবস্থা হয়। অধিকাংশ স্থলেই কোনো পরিবর্তন হয় না ; যথা, কেশ বেশ পেট হেঁট বেল তেল তেজ শেজ খেদ বেদ প্ৰেম হেম ইত্যাদি । কিন্তু দন্ত্য ন-এর পূর্বে ইহার ব্যতিক্রম দেখা যায় ; যথা, ফেন (ভাতের) সেন (পদবী) কেন যেন হেন। মূর্ধন্য ণ-এর পূর্বেও সম্ভবত এই নিয়ম খাটে, কিন্তু প্রচলিত বাংলায় তাহার কোনো উদাহরণ পাওয়া যায় না । একটা কেবল উল্লেখ করি, কেহ কেহ দিনক্ষণ-কে দিনখ্যান বলিয়া থাকেন। এইখানে পাঠকদিগকে বলিয়া রাখি, ন অক্ষর যে কেবল একারকে আক্রমণ করে তাহা নহে, অকারের প্রতিও তাহার বক্ৰদূষ্টি আছে- বন মন ধন জন প্রভৃতি শব্দের প্রচলিত উচ্চারণ প্রণিধান করিয়া দেখিলে দেখা যাইবে, উক্ত শব্দগুলিতে আদ্যক্ষরযুক্ত অকারের বিকৃতি ঘটিয়াছে। বট মঠ জল প্রভৃতি শব্দের প্রথমাক্ষরের সহিত তুলনা করিলে আমার কথা স্পষ্ট হইবে। আমার বিশ্বাস, পরবতী চ অক্ষরও এইরূপ বিকার্যজনক । কিন্তু কথা বড়ো বেশি পাওয়া যায় না । একটা কথা আছে- প্যাচ । কিন্তু সেটা যে পেঁচ-শব্দ হইতে রূপান্তরিত হইয়াছে, এমন অনুমান করিবার কোনো কারণ নাই । আর-একটা বলা যায়- ‘ট্যাচ” । ‘ট্যাচ’ করিয়া দেওয়া । এ শব্দ সম্বন্ধেও পূর্বকথা খাটে। অতএব এটাকে নিয়ম বলিয়া মানিতে পারি না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গবাসী পাঠকেরা কাল্পনিক শব্দবিন্যাস দ্বারা চেষ্টা করিয়া দেখিবেন, চ-এর পূর্বে বিশুদ্ধ এ-কার উচ্চারণ জিহবার পক্ষে কেমন সহজ বোধ হয় না। এখানে বলা আবশ্যক, আমি দুই অক্ষরের কথা লইয়া আলোচনা করিতেছি । পূর্বনিয়মের দুটাে-একটা ব্যতিক্রম আছে। কোনো পাঠক যদি তাহার কারণ বাহির করিতে পারেন তো সুখী হইব । এ দিকে “ভেক' উচ্চারণে কোনো গোলযোগ নাই, অথচ 'এক শব্দ উচ্চারণে ‘এ’ স্বর বিকৃত হইয়াছে। আর-একটা ব্যতিক্রম- লেজ (লাঙ্গুল) । তেজ শব্দের একার বিশুদ্ধ, লেজ শব্দের একার বিকৃত । বাংলায় দুই শ্রেণীর শব্দদ্বিগুণীকরণ প্ৰথা প্রচলিত আছে : ১ । বিশেষণ ও অসমাপিকা ক্রিয়াপদ ; যথা, বড়ো-বড়ো ছোটো-ছোটাে বঁকা-বাক নোচে-নোচে গেয়ে-গেয়ে হোসে-হেসে ইত্যাদি । ২। শব্দানুকরণমূলক বর্ণনাসূচক ক্রিয়ার বিশেষণ। যথা প্যাটর্প্যাট টাটী খিট-খিটি ইত্যাদি। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর দ্বিগুণীকরণের স্থলে পাঠক কুত্ৰাপিও আদ্যক্ষরে একার সংযোগ দেখিতে পাইবেন না । গাৰ্গা গোর্গো চীচী চ্যােচ্য টুকটুক পাইবেন, কিন্তু গোর্গে চেচে কোথাও নাই। কেবল নিতান্ত যেখানে শব্দের অবিকল অনুকরণ সেইখানেই দৈবাৎ একারের সংস্রব পাওয়া যায়, যথা ঘেউঘেউ । এইরূপ স্থলে অ্যাকারের প্রাদুর্ভাবটাই কিছু বেশি ; যথা, ফ্যাসফ্যাস খ্যাকাখ্যাক সঁ্যাৎস্যাৎ ম্যাড়ম্যাড় । ' এই শব্দগুলিকে বিশেষণে পরিণত করিলে দ্বিতীয়ার্ধের প্রথমে অ্যাকারের পরিবর্তে একার সংযুক্ত হয় ; যথা, সঁ্যাৎসেঁতে ম্যাড়মেড়ে। তাহার কারণ পূর্বেই আভাস দিয়াছি। সঁ্যাৎস্যতিয়া হইতে সঁ্যাৎসেঁতে হইয়াছে। বলা হইয়াছে ইকারের পূর্বে ‘এ’ উচ্চারণ বলবান থাকে । ক্রিয়াপদজাত বিশেষ্য শব্দের একারের উচ্চারণ সম্বন্ধে একটি বিশেষ নিয়ম সন্ধান করা আবশ্যক | দৃষ্টান্তস্বরূপে দেখো, খেলা এবং গেলা (গলাধঃকরণ), ইহাদের প্রথমাক্ষরবতী একারের উচ্চারণভের্দ দেখা যায়। প্রথমটি খ্যালা, দ্বিতীয়টি গেলা । ।

  • আমি স্থির করিলাম— সংস্কৃত মূলশব্দের ইকারের অপভ্রংশ বাংলার যেখানে ‘এ’ হয় সেখানে বিশুদ্ধ ‘এ’ উচ্চারণ থাকে। খেলন হইতে খেলা, কিন্তু গিলন হইতে গেলা- এইজন্য শেষোক্ত “