পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শব্দতত্ত্ব VS বাংলা বিশেষণ সম্বন্ধে আলোচ্য বিষয় অনেক আছে, এ স্থলে তাহার বিস্তারিত অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক হইবে । বীমস সাহেব বাংলা উচ্চারণের একটি নিয়ম উল্লেখ করিয়াছেন ; তিনি বলেন, চলিত কথায় আ স্বরের পর ঈ স্বর থাকিলে সাধারণত উভয়ে সংকুচিত হইয়া এ হইয়া যায়। উদাহরণস্বরূপে দিয়াছেন, খাইতে- খেতে, পাইতে- পেতে । এইসঙ্গে বলিয়াছেন, in less common words অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত শব্দে এইরূপ সংকোচ ঘটে না ; যথা, গাইতে হইতে গেতে হয় না । গাইতে শব্দ খাইতে ও পাইতে শব্দ হইতে অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত বলিয়া কেন গণ্য হইবে বুঝা যায় না । তাহার অপরাধের মধ্যে সে একটি নিয়মবিশেষের মধ্যে ধরা দেয় না । কিন্তু তাহার সমান অপরাধী আরো মিলিবে । বাংলায় এই-জাতীয় ক্রিয়াপদ যে-কয়টি আছে, সবগুলি একত্র করা যাক ; ; খাইতে গাইতে চাইতে ছাইতে ধাইতে নাইতে পাইতে বাইতে ও যাইতে । এই নয়টির মধ্যে কেবল । খাইতে পাইতে ও যাইতে, এই তিনটি শব্দ বীমস সাহেবের নিয়ম পালন করে, বাকি ছয়টি অন্য নিয়মে b(F| | এই ছয়টির মধ্যে চারিটি শব্দের মাঝখানে একটা হলুপ্ত হইয়াছে দেখা যায় ; যথা গাহিতে চাহিতে নাহিতে ও বাহিতে (বহন করিতে)। হ আশ্রয় করিয়া যে ইকারগুলি আছে তাহার বল অধিক দেখা যাইতেছে। ইহার অনুকূল অপর দৃষ্টান্ত আছে। করিতে চলিতে প্রভৃতি শব্দে ইকার লোপ হইয়া করতে চলতে হয় ; হইতে শব্দের ইকার লোপ হইয়া হতে এবং লাইতে শব্দের ইকার স্থানভ্রষ্ট হইয়া “নিতে হয় । কিন্তু, বহিতে সহিতে কহিতে শব্দের ইকার বইতে সইতে কইতে শব্দের মধ্যে টিকিয়া যায় । অথচ সমস্ত বর্ণমালায় হ ব্যতীত আর-কোনো অক্ষরের এরূপ ক্ষমতা নাই । লইতে শব্দ লভিতে শব্দ হইতে উৎপন্ন ; ভ হ-এ পরিণত হইয়া ‘লহিতে হয়। তদুৎপন্ন নিতে শব্দে ইকার যদিচ স্থানচ্যুত হইয়াছে তথাপি হ-এর জোরে টিকিয়া গেছে। বীমস। তঁহার উল্লিখিত নিয়মে একটা কথা বলেন নাই। তাহার নিয়ম দুই-অক্ষরের কথায় খাটে না । হাতি শব্দে কোনো পরিবর্তন হয় না, কিন্তু হাতিয়ার শব্দের বিকারে হেতের হয় । আসি শব্দ ঠিক থাকে ; ‘আসিয়া’ হয়- আস্যা, পরে হয়- এসে । খাই শব্দে পরিবর্তন হয় না ; খাইয়া হয়- খায়্যা, পরে হয়— খেয়ে । এইরূপে হাড়িশাল হইতে হয়- হেঁশেল । এ স্থলে এই নিয়মের চূড়ান্ত পর্যালোচনা হইল না ; আমরা কেবল পাঠকদের মনােযোগ আকর্ষণ করিলাম । 'এ' স্বরবর্ণ কোথাও বা ইংরেজি came শব্দস্থিত a স্বরের মতো, কোথাও বা lack শব্দের a-র মতো উচ্চারিত হয়, বীমস তাহাও নির্দেশ করিয়াছেন। ‘এ’ স্বরের উচ্চারণবৈচিত্ৰ্য সম্বন্ধে আমরা সাধনা পত্রিকায় আলোচনা করিয়াছি। বীমস সাহেব লিখিয়াছেন, যাওয়া-সম্বন্ধীয় ক্রিয়াপদ গোল শব্দের উচ্চারণ গ্যাল হইয়াছে, গিলিবার সম্বন্ধীয় ক্রিয়াপদ গেল শব্দের উচ্চারণে বিশুদ্ধ একার রক্ষিত হইয়াছে । তিনি বলেন, অভ্যাস ব্যতীত ইহার নির্ণয়ের অন্য উপায় নাই। কিন্তু এই ক্রিয়াপদগুলি সম্বন্ধে একটি সহজ নিয়ম আছে । যে-সকল ক্রিয়াপদের আরম্ভ-শব্দে ইকার আছে, যথা, গিল মিল ইত্যাদি, তাহারা ইকারের পরিবর্তে একার গ্রহণ করিলে একারের উচ্চারণ বিশুদ্ধ থাকে ; যথা, গিলন হইতে গেলা, মিলন হইতে মেলা (মেলন শব্দ হইতে যে মেলা-র উৎপত্তি তাহার উচ্চারণ ম্যালা), লিখন হইতে লেখা, শিক্ষণ হইতে শেখা ইত্যাদি । অন্য সর্বত্রই একরের উচ্চারণ অ্যা হইয়া যায় ; যথা, খেলন- খেলা, ঠেলন- “ ঠেলা, দেখন— দেখা ইত্যাদি। অর্থাৎ গােড়ায় যেখানে ই থাকে সেটা হয় এ, গোড়ায় যেখানে এ থাকে সেটা হয় অ্যা। গোড়ায় কোথায় এ আছে এবং কোথায়ই আছে, তাহা ইতে প্রত্যয়ের দ্বারা ধরা। ேযথা, গিলিতে মিলিতে লিখিতে শিখিতে মিটিতে পিটিতে ; অন্যত্র, খেলিতে ঠেলিতে দেখিতে । বেঁকিতে মেলিতে হেলিতে ইত্যাদি ।