পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8V রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী একটা বিকৃত ছায়া যোগ করিয়া দিয়া চুপচাপ হইয়া গেল। ইহাতে অর্থেরও একটু অনির্দিষ্টভাবের বিস্তৃতি হইল। যদি বলা যায় কেহ চুপ করিয়া আছে, তবে বুঝায় সে নিঃশব্দ হইয়া আছে ; কিন্তু যদি বলি চুপচাপ আছে, তবে বুঝায় লোকটা কেবলমাত্র নিঃশব্দ নহে একপ্রকার নিশ্চেষ্ট হইয়াও আছে। একটা নির্দিষ্ট অর্থের পশ্চাতে একটা অনির্দিষ্ট আভাস জুড়িয়া দেওয়া এই শ্রেণীর জোড়া কথার কাজ । ছায়াটা আসল জিনিসের চেয়ে বড়োই হইয়া থাকে। অনির্দিষ্টটা নিদিষ্ট্রের চেয়ে অনেক মস্ত । আকার স্বরটাই বাংলায় বড়োত্রে সুর লাগাইবার জন্য আছে। আকার স্বরবর্ণের যোগে ঘুষঘাষ-এর ঘাষ, তুকতাক-এর তাক, ঘুষ অর্থ ও তুক অর্থকে কল্পনাক্ষেত্রে অনেকখানি বাড়াইয়া দিল অথচ স্পষ্ট কিছুই বলিল না। কিন্তু যেখানে মূলশব্দে আকার আছে সেখানে দোসর শব্দে এ নিয়ম খাটে না, পুনর্বার আকার যোগ করিলে কথাটা দ্বিগুণিত হইয়া পড়ে। কিন্তু দ্বিগুণিত করিলে তাহার অর্থ অন্য রকম হইয়া যায়। যদি বলি গোল-গোল, তাহাতে হয় একাধিক গোল পদার্থকে বুঝায় নয় প্রায়-গোল জিনিসকে বুঝায়। কিন্তু গোল-গাল বলিলে গোল আকৃতি বুঝায়, সেইসঙ্গেই পরিপুষ্টতা প্রভৃতি আরো কিছু অনির্দিষ্ট ভােব মনে আনিয়া দেয় । এইজন্য এইপ্ৰকার অনির্দিষ্ট ব্যঞ্জনার স্থলে দ্বিগুণিত করা চলে না, বিকৃতির প্রয়ােজন। তাই গোড়ায় যেখানে আকার আছে সেখানে দোসর শব্দে অন্য স্বরবর্ণের প্রয়োজন ; তাহার দৃষ্টান্ত, দাগদ্যোগ ডাকডোক বাছবোছ সাজসোজা ছাট ছোট চালচোল ধারধোর সাফসোফি । অন্যরকম : কাটাকোটা খাটাখোটা ডাকাডোকা ঢাকঢোকা ঘাটার্যোটা ছাটাছোট ঝাড়াঝোড়া চাপাচোপা ঠাসাঠোসা কালোকোলো । ঝাড়া ঝুড়ি ভাজাভুজি তাড়াতুড়ি টানটুনি চাপাচুপি ঠাসাঠুসি। এইগুলি ক্রিয়াপদ হইতে উৎপন্ন । বিশেষ্যপদ হইতে উৎপন্ন শব্দ : র্কাটাকুটি ঠাট্টাঠটি ধাক্কাধুব্ধি । শেষোক্ত দৃষ্টান্ত হইতে দেখা যায়, পূর্বে আকার ও পরে ইকার থাকিলে মাঝখানের ওকারটি উচ্চারণের সুবিধার জন্য উকাররূপ ধরে । শুদ্ধমাত্র ‘কোটি" উচ্চারণ সহজ, কিন্তু ‘কোটাকোটি দ্রুত উচ্চারণের পক্ষে ব্যাঘাতজনক । চাপাচোপি ডাকাডোকি ঘাটাৰ্ঘোটি, উচ্চারণের চেষ্টা করিলেই ইহা বুঝা যাইবে, অথচ চুপি ডুকি ঘুটি উচ্চারণ কঠিন নহে। তাহা হইলে মোটের উপরে দেখা যাইতেছে যে, জোড়া কথাগুলির প্রথমাংশের আদ্যক্ষরে যেখানে ই উ বা ও আছে সেখানে দ্বিতীয়াংশে আকার-স্বর যুক্ত হয় ; যেমন, ঠিকঠাক মিটমাট ফিটফট ভিড়ভাড়া ঢিলেঢালা ঢিপঢপ ইত্যাদি ; কুচোকাচা গুড়োগাড়া গুতোগাতা কুটােকাটা ফুটােফাটা । ভুজংভাজং টুকরো-টাকরা হুকুম-হাকাম শুকনো-শাকনা ; গোলগাল যোগােযাগ সোরসার রোখরাখ খোচখাচ গোছগাছ মোটমাটি খোপ খাপ খোলাখালা জোগাড়-জাগাড় । 媳 কিন্তু যেখানে প্রথমাংশের আদ্যক্ষরে আকার যুক্ত আছে সেখানে দ্বিতীয়াংশে ওকার জুড়িতে হয় | ইহার দৃষ্টান্ত পূর্বেই দেওয়া হইয়াছে ; জোগাড় শব্দের বেলায় হইল জোগাড়-জাগাড়, ডাগর শব্দের বেলায় হইল ডাগর-ডোগর । একদিকে দেখে টুকরো-টােকরা হুকুম-হাকাম, অন্য দিকে হাপুস-হুপুস নাদুস-নুদুস। ইহাতে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, আকারে ওকারে একটা বোঝাপড়া আছে। ফিরিঙ্গি যেমন ইংরেজের চালে চলে, আমাদের সংকরজাতীয় অ্যাকারও এখানে আকারের নিয়ম রক্ষা করেন ; যথা, ঠ্যাকা-ঠোকা গ্যাটাগোটা অ্যালাগোলা । উল্লিখিত নিয়মটি বিশেষ শ্রেণীর কথা সম্বন্ধেই খাটে, অর্থাৎ যে-সকল কথায় প্রথমার্ধের অর্থ নির্দিষ্ট ও দ্বিতীয়ার্ধের অর্থ অনির্দিষ্ট ; যেমন ঘুষোঘাষা। কিন্তু ঘুষোঘুষি কথাটার ভাব অন্য রকম, তাহার অর্থ দুই পক্ষ হইতে সুস্পষ্ট ঘুষি-চালাচালি ; ইহার মধ্যে আভাস ইঙ্গিত কিছুই নাই। এখানে দ্বিতীয়াংশের আদ্যক্ষরে সেইজন্য স্বরবিকার হয় নাই। : এইরূপ ঘুষোনুষি-দলের কথাগুলি সাধারণত অন্যোন্যতা বুঝাইয়া থাকে ; কানাকানি-র মানে, এর