পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । সমাজ \ኃbr(? অগ্রহায়ণ মাসের ‘সাহিত্যে শ্ৰীযুক্ত চন্দ্রনাথ বসু মহাশয় আহার নামক এক প্ৰবন্ধ লিখিয়াছেন । র্তাহার মতে আহারের দুই উদ্দেশ্য, দেহের পুষ্টিসাধন ও আত্মার শক্তিবর্ধন । তিনি বলেন, আহারে দেহের পুষ্টি হয়। এ কথা সকল দেশের লোকই জানে, কিন্তু আত্মার শক্তিবর্ধনও যে উহার একটা কার্যের মধ্যেএ-রহস্য কেবল ভারতবর্ষেই বিদিত ; কেবল ইংরেজি শিখিয়া এই নিগুঢ় তথ্য ভুলিয়া ইংরেজি শিক্ষিতগণ লোভের তাড়নায় পাশব আহারে প্রবৃত্ত হইয়াছেন এবং ধর্মশীলতা শ্রমশীলতা ব্যাধিহীনতা দীর্ঘজীবিতা, হৃদয়ের কমনীয়তা, চরিত্রের নির্মলতা, সাত্ত্বি আধ্যাত্মিকতা সমস্ত হারাইতে বসিয়াছেন ; তিনি বলেন, এই আহার-তথ্যের “শিক্ষা গুরুপুরোহিতেরা দিলেই ভালো হয় । কিন্তু তাহারা যদি এ শিক্ষা দিতে অক্ষম হন তবে শাস্ত্ৰজ্ঞ ব্যক্তিমাত্ৰকেই এ শিক্ষা দিতে হইবে।” এই বলিয়া, তিনি নিজে উক্ত কার্যে প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন ; এবং ব্ৰাহ্মণ অধ্যাপকের দৃষ্টান্ত দেখাইয়া প্ৰকাশ করিয়াছেন, “নিরামিষ আহারে দেহ মন উভয়েরই যেরূপ পুষ্টি হয়, আমিষযুক্ত আহারে সেরূপ হয় না ।” এই লেখা সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য নিম্নে প্ৰকাশ করিলাম । নিশ্চয়ই লেখক মহাশয়ের অগোচর নাই যে, ইংরেজিশিক্ষিত নব্যগণ যে কেবল আমিষ খান তাহা নয়, তাহারা গুরুবাক্য মানেন না । কতকগুলি কথা আছে যাহার উপরে তর্কবিতর্ক চলিতে পারে । আহার প্রসঙ্গটি সেই শ্রেণীভুক্ত । লেখকমহাশয় তাহার প্রবন্ধে কেবল একটিমাত্র যুক্তি প্রয়োগ করিয়াছেন এবং তাঁহা উক্ত রচনার সর্বপ্রান্তে নিবিষ্ট করিয়াছেন ; সেটি তাহার স্বাক্ষর শ্ৰীচন্দ্রনাথ বসু। পূর্বকালের বাদশাহেরা যখন কাহারও মুণ্ড আনিতে বলিতেন তখন আদেশপত্রে এইরূপ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত যুক্তি প্রয়োগ করিতেন ; এবং গুরুপুরোহিতেরাও সচরাচর নানা কারণে এইরূপ যুক্তিকেই সর্বপ্রাধান্য দিয়া থাকেন । কিন্তু ইংরেজ বাদশাহ কাহারও মুণ্ডপাত করিবার পূর্বে বিস্তারিত যুক্তিনির্দেশ বাহুল্য জ্ঞান করেন না, এবং ইংরেজ গুরু মত জাহির করিবার পূর্বে প্রমাণ প্রয়োগ করিতে না পারিলে গুরুপদ হইতে বিচ্যুত হন । আমরা অবস্থা গতিকে সেই ইংরেজরাজের প্রজা সেই ইংরেজ গুরুর ছাত্র, অতএব চন্দ্ৰনাথবাবুর স্বাক্ষরের প্রতি আমাদের যথোচিত শ্রদ্ধা থাকিলেও তাহা ছাড়াও আমরা প্ৰমাণ প্ৰত্যাশা করিয়া থাকি । ইহাকে কুশিক্ষা বা সুশিক্ষা যাহাই বল, অবস্থােটা এইরূপ । প্রাচীন ভারতবর্ষে আহার সম্বন্ধে কী নিগুঢ় তত্ত্ব প্রচলিত ছিল জানি না এবং চন্দ্রনাথবাবুও নব্যশিক্ষিতদের নিকটে তাহা গোপন করিয়াই গেছেন, কিন্তু রাজেন্দ্রলাল মিত্ৰ মহােদয় প্রমাণ করিয়াছেন প্ৰাচীন ভারতের আহার্যের মধ্যে মাংসের চলন না ছিল এমন নহে । এক সময়ে ব্ৰাহ্মণের আমিষ ত্যাগ করিয়াছিলেন ; কিন্তু একমাত্ৰ ব্ৰাহ্মণের দ্বারা কোনো সমাজ রচিত হইতে পারে না । ভারতবর্ষে কেবল বিংশতি কোটি অধ্যাপক পুরোহিত এবং তপস্বীর প্রাদুর্ভাব হইলে অতি সত্বরই সেই সুপবিত্র জনসংখ্যার হ্রাস হইবার সম্ভাবনা। প্রাচীন ভারতবর্ষে ধ্যানশীল ব্ৰাহ্মণও ছিল এবং কর্মশীল ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য শূদ্রও ছিল, মগজও ছিল মাংসপেশীও ছিল, সুতরাং স্বাভাবিক আবশ্যক-অনুসারে আমিষও ছিল নিরামিষও ছিল, আচারের সংযমও ছিল আচারের অপেক্ষাকৃত স্বাধীনতাও ছিল। যখন সমাজে ক্ষত্ৰিয়তেজ ছিল তখনই ব্ৰাহ্মণের সাত্ত্বিকতা উজ্জ্বলভাবে শোভা পাইত- শক্তি থাকিলে যেমন ক্ষমা শোভা পায়, সেইরূপ । অবশেষে সমাজ যখন আপনার যৌবনতেজ হারাইয়া আগাগোড়া সকলে মিলিয়া সাত্ত্বিক সাজিতে বসিল, কর্মনিষ্ঠ সকল বর্ণ ব্ৰাহ্মণের সহিত লিপ্ত হইয়া লুপ্ত হইয়া গেল, এই বৃহৎ ভূভাগে কেবল ব্ৰাহ্মণ এবং ব্ৰাহ্মণের পদানুবতী একটা ছায়ামাত্র অবশিষ্ট রহিল তখনই প্ৰাচীন ভারতবর্ষের বিনাশ হইল। তখন নিস্তেজতাই আধ্যাত্মিকতার অনুকরণ করিয়া অতি সহজে যন্ত্রাচারী এবং কর্মক্ষেত্রের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হইয়া উঠিল। ভীরুর ধৈর্য আপনাকে মহতের ধৈর্য বলিয়া পরিচয় দিল, নিশ্চেষ্টতা বৈরাগ্যের ভেক ধারণ করিল এবং দুর্ভাগ অক্ষম। ভারতবর্ষ ব্ৰাহ্মণইন ব্ৰাহ্মণের গোরুটি হইয়া তাহারই ঘানিগাছের চতুর্দিকে নিয়ত প্ৰদক্ষিণ