পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२७ রবীন্দ্র-রচনাবলী ত্যাগসাধ্য ক্লেশসাধ্য মঙ্গল-অনুষ্ঠানে প্ৰবৃত্ত হইতে পারে নাই, পরের প্রতি রাগ করিয়া আজ সেই দেশ যে স্থায়ীভাবে কোনো দুষ্কর তপশ্চরণে নিযুক্ত হইবে, এরূপ শ্রদ্ধা রক্ষা করা বড়োই কঠিন। রাগারগির স্টীম চিরদিন জ্বালাইয়া রাখিবে কে এবং রাখিলেই বা মঙ্গল কী । গ্যাস ফুরাইলেই যদি বেলুন মাটিতে আছাড় খাইয়া পড়ে, তবে সেই বেলুনে বাস্তুবাড়ি স্থাপনের আশা করা চলে না। আজ র্যাহারা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া বলিতেছেন, আমাদের এখনই আস্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় চাই, কালই সেখানে পরীক্ষা দিতে যাইব, তাহাদিগকে দেশীয় বিদ্যালয়প্রতিষ্ঠার স্থায়ী সহায় বলিয়া মনে করিতে সাহস হয় না । এমন-কি, তাহারা ইহার বিষ্মস্বরূপ হইতেও পারেন । কারণ, তাহারা স্বভাবতই অসহিষ্ণু অবস্থায় রহিয়াছেন। তাহারা কোনোমতেই ধৈর্য ধরিতে পারিতেছেন না । প্ৰবল ক্ষমতাশালী পক্ষের প্রতি রাগ করিয়া যখন মনে জেদ জন্মে, তখন অতি সত্বর যে অসাধ্য সাধন করিবার ইচ্ছা হয় তাহা ইন্দ্ৰজালের দ্বারাই সম্ভব । সেই ইন্দ্ৰজাল ক্ষণকালের জন্য একটা বৃহৎ বিভ্রম বিস্তার করে মাত্র, তাহার উপর নির্ভর করা যায় না। কিন্তু মায়ার ভরসা ছাড়িয়া দিয়া যদি যথার্থ কাজের প্রত্যাশা করা যায়, তবে ধৈৰ্য ধরিতেই হইবে । কাজের নিয়মকে স্বীকার করিতেই হইবে । ছােটাে আরম্ভের প্রতি ধৈর্য রক্ষা করা যথার্থ গ্ৰীতির লক্ষণ। সেইজন্য শিশুকে মানুষ করিয়া তুলিতে পিতৃমাতৃস্নেহের প্রয়োজন হয়। যথার্থ স্বদেশগ্ৰীতি প্রবর্তনায় যখন আমরা কোনো কাজ আরম্ভ করি, তখন ক্ষুদ্র আরম্ভের প্রতিও আমরা অন্তরের সমস্ত স্নেহ ঢালিয়া দিতে পারি। তখন কেবলই এই ভয় হইতে থাকে, পাছে অতিরিক্ত প্রলোভনের তাগিদে তাড়াহুড়া করিয়া সমস্ত নষ্ট হইয়া যায় । কিন্তু বিপক্ষপক্ষের প্রতি স্পর্ধা করিয়া যখন আমরা কোনো উদ্যোগে প্ৰবৃত্ত হই। তখন আমাদের বিলম্ব সয় না। তখন আমরা এক মুহুর্তেই শেষকে দেখিতে চাই, আরম্ভকে দুই চক্ষে দেখিতে পারি না । সেইজন্য আরম্ভকে আমরা কেবলই বার বার আঘাত করিতে থাকি । দেশীয় বিদ্যালয়প্রতিষ্ঠার উদযোগে প্রথম হইতেই আমাদের এই-যে আঘাতকর। অধৈর্যের লক্ষণ দেখা যাইতেছে, ইহাই আমাদের আশঙ্কার বিষয় । কাজের সূত্রপাত হইতেই আমরা বিবাদ শুরু করিয়াছি। আমাদের র্যাহার যতটুকু মনের-মতো না হইতেছে, র্যাহার যে পরিমাণ কল্পনাবৃত্তি অপরিতৃপ্ত থাকিতেছে, তিনি তাহার চতুর্গুণ আক্রোশের সহিত এই উদযোগকে আঘাত করিতেছেন। এ কথা বলিতেছেন না, “আচ্ছা, হউক, পাচজনে মিলিয়া কাজটা আরম্ভ হউক ; কোনো জিনিস যে আরম্ভেই একেবারে নিখুঁতসুন্দর এবং সর্ববাদিসম্মত হইয়া উঠিবে, এরূপ আশা করা যায় না ; কিন্তু এমন কোনো ব্যাপারকে যদি খাড়া করিয়া তোলা যায় যাহা চিরদিনের মতো জাতীয় সম্বল হইয়া উঠে, তবে সমস্ত জাতির সুবুদ্ধি নিশ্চয়ই ক্ৰমে ক্রমে তাহাকে নিজের সম্পূর্ণ উপযোগী করিয়া তুলিবে ।” বাংলাদেশে স্বদেশী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে-সকল সভা-সমিতি বসিয়াছে, তাহার মধ্যে নানা করিতেছেন, তাহা ইহাদের প্রত্যেকেরই সম্পূর্ণ মনঃপূত হইতে পারে না। এই সকল সমিতির সঙ্গে বর্তমান লেখকেরও যোগ ছিল । প্ৰস্তাবিত বিদ্যালয়ের যে শিক্ষণপ্ৰণালী ও নিয়ম নির্ধারিত হইয়াছে, লেখকের যদি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিত তবে ঠিক সেরূপ হইত না সন্দেহ নাই ; কিন্তু তাহা লইয়া লেখক বিবাদ করিতে প্ৰস্তুত নহেন । তিনি কাজ আরম্ভ হওয়াকেই সকলের চেয়ে বেশি মনে করেন । যদি তাহার মনোমত প্ৰণালীই বাস্তবিক সর্বোৎকৃষ্ট হয়, তবে কাজ আরম্ভ হইলে পর সে প্রণালীর প্রবর্তন যথাকলে সম্ভবপর হইবে, এ ধৈর্য র্তাহাকে রক্ষা করিতেই হইবে । সাধারণের সম্মানভাজন শ্ৰীযুক্ত গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় প্রস্তাবিত বিদ্যালয়ের আদৰ্শরচনাসমিতির সভাপতি ছিলেন । তিনি যেরূপ চিন্তা, শ্রম ও বিচক্ষণতা সহকারে আদৰ্শরচনা কার্যে সহায়তা করিয়াছেন, তাহাতে তাহার নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেই হইবে । সর্ববিষয়ে তাহার