পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

༢༩༤ রবীন্দ্র-রচনাবলী সংস্কৃত ও বাংলায় কেবল যে কারক-বিভক্তির সংখ্যায় মিল নাই, তাহা নহে। তাহার চেয়ে গুরুতর অনৈক্য আছে। সংস্কৃত ভাষায় কর্তৃবাচ্যে ক্রিয়াপদের জটিলতা বিস্তর ; এইজন্য আধুনিক গৌড়ীয় ভাষাগুলি সংস্কৃত কর্মবাচ্য অবলম্বন করিয়াই প্রধানত উদ্ভূত। ‘করিল ক্রিয়াপদ ‘কৃত হইতে, “করিব করিবে কর্তব্য হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা এ প্রবন্ধে হওয়া সম্ভবপর নহে ; হার্নাল-সাহেব তাহার তুলনামূলক গৌড়ীয় ব্যাকরণে ইহার প্রভূত প্রমাণ দিয়াছেন । এই কর্মবাচ্যের ক্রিয়া বাংলায় কর্তৃবাচ্যে ব্যবহার হইতে থাকায় সংস্কৃত ব্যাকরণ আর তাহাকে বাগ মানাইতে পারে না। সংস্কৃত তৃতীয়া বিভক্তি 'এন' বাংলায় ‘এ’ হইয়াছে ; যেমন, বাশে মাথা ফাটিয়াছে, চােখে দেখিতে পাই না ইত্যাদি। বাঘে খাইল, কথাটার ঠিক সংস্কৃত তর্জমা ব্যান্ত্রেণ খাদিতঃ । কিন্তু খাদিত শব্দ বাংলায় খাইল আকার ধারণ করিয়া কর্তৃবাচ্যের কাজ করিতে লাগিল ; সুতরাং বাঘ যাহাকে । খাইল, সে বেচারা আর কর্তৃকারকের রূপ ধরিতে পারে না। এইজন্য, ব্যান্ত্রেণ রামঃ খাদিতঃ, বাংলায় হইল বাঘে রামকে খাইল ; বাঘে শব্দে করণকারকের এ-কার বিভক্তি থাকা সত্ত্বেও রাম শব্দে কর্মকারকের কে বিভক্তি লাগিল। এ খিচুড়ি সংস্কৃত ব্যাকরণের কোনো পর্যায়েই পড়ে না। পণ্ডিতমশায় বলিতে পারেন, হর্নলে সাহেব-টাহেব আমি মানি না, বাংলায় এ-কার বিভক্তি কর্তৃকারকের বিভক্তি । আচ্ছা দেখা যাক, তেমন করিয়া মেলানো যায় কি না। ধনে শ্যামকে বশ করা গেছে, ইহার সংস্কৃত অনুবাদ ধনেন শ্যামো বশীকৃতঃ । কিন্তু বাংলাবাক্যটির কর্তা কে । ‘ধনে যদি কর্তা হইত, তবে করা গেছে ক্রিয়া করিয়াছে রূপ ধরিত । “তঁহাকে’ শব্দ কর্তা নহে, “কে’ বিভক্তিই তাহার সাক্ষ্য দিতেছে । কর্তা উহ্য আছে বলা যায় না ; কারণ করা গেছে ক্রিয় কর্তা মানে না, আমরা করা গেছে, তাহারা করা গেছে, হয় না । অথচ ভাবার্থ দেখিতে গেলে, “বশ করা গেছে ক্রিয়ার কর্তা উহ্যভাবে “আমরা’। করা গেছে, খাওয়া গেছে, হওয়া গেছে, সর্বত্রই উত্তম পুরুষ। কিন্তু এই “আমরা কথাটাকে স্পষ্টভাবে ব্যবহার করিবার জো নাই ; আমরা আয়োজন করা গেছে, বলিতেই পারি না । এইরূপ কর্তৃহীন কবন্ধবাক্য সংস্কৃত ভাষায় হয় না বলিয়া কি পণ্ডিতমশায় বাংলা হইতে ইহাদিগকে নির্বাসিত করিয়া দিবেন । তাহা হইলে ঠগ বাছিতে গা উজাড় হইবে । তাহাকে নাচিতে হইবে, কথাটার সংস্কৃত কী। তাং নির্তিতুং ভবিষ্যতি, নহে। যদি বলি, নচিতে হইবে এক কথা, তবু তাং নৰ্তব্যম হয় না। অতএব দেখা যাইতেছে, সংস্কৃতে যেখানে ‘তয়া নর্তব্যম বাংলায় সেখানে ‘তাঁহাকে নাচিতে হইবে । ইহা বাংলা ব্যাকরণ না সংস্কৃত ব্যাকরণ ? আমার করা চাই- এই চাই ক্রিয়াটা কী । ইহার আকার দেখিয়া ইহাকে উত্তমপুরুষ বোধ হয়, কিন্তু সংস্কৃতে ইহাকে ‘মিম করণং যাচে বলা চলে না। বাংলাতেও “আমি আমার করা চাই এমন কখনো বলি না । বস্তুত “আমার করা চাই যখন বলি, তখন । অধিকাংশ সময়েই সেটা আমি চাই না, পেয়াদায় চায়। অতএব এই চাই ক্রিয়াটা সংস্কৃত ব্যাকরণের কোন জিনিসটার কোন সম্বন্ধী। আমাকে তোমার পড়াতে হবে, এখানে “তােমার সর্বনামটি সংস্কৃত কোন নিয়মমতে সম্বন্ধপদ হয়। এই বাক্যের অনুবাদ ত্বং মাং পাঠয়িতুম অৰ্হসি ; এখানে ত্বং কর্তৃকারক ও প্রথমা এবং অৰ্হসি মধ্যম পুরুষ- কিন্তু বাংলায় “তোমার সম্বন্ধপদ এবং হবে। প্ৰথমপুরুষ । সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে এ-সকল বাক্য সাধা অসাধ্য, বাংলাভাষার নিয়মে এগুলিকে পরিত্যাগ করা ততোধিক অসাধ্য। পণ্ডিতমশায় কোন পথে যাইবেন । “আমাকে তোমার পড়াতে হবে। বাক্যটির প্রত্যেক শব্দই সংস্কৃতমূলক, অথচ ইহার প্রত্যেক শব্দটিতেই সংস্কৃতনিয়ম লঙ্ঘন হইয়াছে। অপর পক্ষে বলিতে পারেন, যেখানে সংস্কৃতে বাংলায় যথার্থ প্ৰভেদ ঘটিয়াছে, সেখানে প্রভেদ মানিতে রাজি আছি, কিন্তু যেখানে প্রভেদ নাই, সেখানে তো ঐক্য স্বীকার করিতে হয়। যেমন সংস্কৃত ভাষায় ইন প্রত্যয়যোগে ‘বাস হইতে ‘বাসী হয়, তেমনই সেই সংস্কৃত ‘ইন প্রত্যয়ের যোগেই বাংলা দাগ হইতে দাগী হয়- বাংলা প্রত্যয়টাকে কেহ যদি ই প্রত্যয় নাম দেয়। তবে সে অন্যায় করে। আমরা বলিয়ছিলাম বটে যে, চাষি, দামি, দাগি, দোকানি প্রভৃতি শব্দ সংস্কৃত ইন প্রত্যয়যোগে নহে, বাংলা ই প্রত্যয়যোগে হইয়াছে। কেন বলিয়াছিলাম বলি। " জিজ্ঞাস্য এই যে, বাসী শব্দ যে প্রত্যয়যোগে ঈ গ্ৰহণ করিয়াছে, তাহাকে ঈ প্রত্যয় না বলিয়া ইন ,