পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্ৰন্থপরিচয় AAS বেগমমণ্ডলী বাদশার-পরিবৃত যে প্ৰেম, কালিদাস হংসপদিকার মুখ থেকে তাকে লাঞ্ছিত করেছেন । সে প্ৰেম চলিত পথের । ধুলোর উপরে তার খেলাঘর। মমতাজ যথাসময়ে মারা গিয়েছিল বলেই বিরহের একটি সজীব বীজ সেই খেলাঘরের ধূলির উপরে পড়ে ধূলি হয়ে যায় নি, ক্লান্তিপ্রবণ বিলাসের ক্ষণভঙ্গুরতা অতিক্রম করে অঙ্কুরিত হয়েছিল। তার ভিতরকার অমরতা ক্ষণকালে পরম স্মৃতিকে বহন করে রয়ে গেল। যে-বেদনাকে সেই স্মৃতি ঘোষণা করছে, তারই সঙ্গে সঙ্গে তার আর-একটি ঘোষণা আছে, তার বাণী হচ্ছে এই যে, সেই শাজাহানও নেই সেই মমতাজও নেই, কেবল তাদের যাত্রাপথের এক অংশের ধূলির উপরে । জীবনের ক্ৰন্দনধ্বনি বহন করে রয়ে গেছে তাজমহল। দুষ্যন্ত শকুন্তলার প্রেমের মধ্যে একটা মহিমা আছে, দুই তপোবনের মাঝখান দিয়ে সে গেছে অমরাবতীর দিকে- তার সংকীর্ণ খেলাঘরের বেড়া ভেঙে গিয়েছিল, তাই প্রথম বিলাসবিভ্রমের বিস্মৃতিকে উত্তীর্ণ হয়ে সে তপঃপূত চিরস্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করছে, সে-প্ৰেম দুঃখবন্ধুর পথে অন্তহীন সম্মুখের দিকে চলে গিয়েছে, সম্ভোগের মধ্যে তার সমাপ্তি নয় । আমি জানি শাজাহানের এই অংশটি দুর্বোিধ। তাই এক সময় এটাকে বর্জন করেছিলুম। তার পরে ভাবলুম, কে বোঝে কে না-বোঝে সে-কথার বিচার আমি করতে যাব কেন- তোমাদের মতো অধ্যাপকদের আক্কেলন্দাতের চৰ্য পদার্থ না রেখে গেলে ছাত্রমণ্ডলীদের ধাধা লাগবে কী | “আমার ধর্ম প্রবন্ধে (সবুজ পত্র, আশ্বিন-কার্তিক ১৩২৪) রবীন্দ্রনাথ বলাকার ২২-সংখ্যক । কবিতাটি সম্বন্ধে প্ৰসঙ্গত লিখিয়াছেন : “সত্যং জ্ঞানং অনন্তম । শান্তং শিবং অদ্বৈতম। য়িহুদি পুরাণে আছে- মানুষ একদিন অমৃতলোকে বাস করত। সে-লোক স্বৰ্গলোক। সেখানে দুঃখ নেই, মৃত্যু নেই। কিন্তু যে-স্বৰ্গকে দুঃখের ভিতর দিয়ে, মন্দের সংঘাত দিয়ে না জয় করতে পেরেছি, সে-স্বৰ্গ তো জ্ঞানের স্বৰ্গ নয়- তাকে স্বৰ্গ বলে জানিই নে । মায়ের গর্ভের মধ্যে মাকে পাওয়া যেমন মাকে পাওয়াই নয়- তাকে বিচ্ছেদের মধ্যে পাওয়াই পাওয়া । গৰ্ভ ছেড়ে মাটির পরে যখন পড়ে । তখন ছেলে দেখে আপন মাকে । তোমার আদর যখন ঢাকে, তখন তোমায় নাহি জানি । আঘাত হানি তোমারি আচ্ছাদন হতে যেদিন দূরে ফেলাও টানি— । সে-বিচ্ছেদে চেতনা দেয় আনি দেখি বদনখানি । তাই সে অচেতন স্বৰ্গলোকে জ্ঞান এল । সেই জ্ঞান আসতেই সত্যের মধ্যে আত্মবিচ্ছেদ ঘটল । সত্য মিথ্যা, ভালো মন্দ, জীবন মৃত্যুর দ্বন্দ্ব এসে স্বৰ্গ থেকে মানুষকে লজ্জা দুঃখ বেদনার মধ্যে নির্বাসিত করে দিলে। এই দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে যে অখণ্ড সত্যে মানুষ আবার ফিরে আসে, তার থেকে তার আর বিচূতি নেই। কিন্তু এই সমস্ত বিপরীতের বিরোধ মিটতে পারে কোথায় - অনন্তের মধ্যে। তাই উপনিষদে আছে সত্যং জ্ঞানং অনন্তম। প্রথমে সত্যের মধ্যে জড় জীব সকলেরই সঙ্গে এক হয়ে মানুষ বাস করে- জ্ঞান এসে বিরোধ ঘটিয়ে মানুষকে সেখান থেকে টেনে স্বতন্ত্র করে— অবশেষে সত্যের পরিপূর্ণ অনন্ত রূপের ক্ষেত্রে আবার তাকে