পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳԵrՀ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অচলায়তন ১৩১৮ সালে গ্ৰন্থাকারে প্রকাশিত হয় ! অচলায়তন ১৩১৮ সালের আশ্বিন মাসের প্রবাসীতে সম্পূর্ণ মুদ্রিত হইয়াছিল । রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে চারুচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি পত্রে (পোস্টমার্ক : শান্তিনিকেতন ১৪ জুলাই >>> 8) GrCra “শেষকালে নাটকটা প্ৰবাসীর কবলের মধ্যেই পড়ল । অনেক লোকের চক্ষে পড়বে এবং এই নিয়ে কাগজপত্রে বিস্তর মারামারি-কাটাকাটি চলবে এই আমার একটা মস্ত সাস্তুনা ।” এই অনুমান ব্যর্থ হয় নাই । প্রবাসীতে নাটকটি প্রকাশিত হইলে অধ্যাপক ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আৰ্য্যাবৰ্ত্ত মাসিক পত্রে (কার্তিক ১৩১৮) ইহার একটি সমালোচনা প্ৰকাশ করেন ; ইহাতে নাটকটির প্রশস্তি ও তিরস্কার দুইই ছিল। ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ এই সমালোচনার উত্তর দেন ; পত্রটি “আৰ্য্যাবৰ্ত্তে (অগ্রহায়ণ ১৩১৮) প্ৰকাশিত হয় ; নিম্নে তাহা মুদ্রিত হইল “নিজের লেখা সম্বন্ধে কোনোপ্রকার ওকালতি করিতে যাওয়া ভদ্ররীতি নহে । সে রীতি আমি সাধারণত মানিয়া থাকি । কিন্তু আপনার মতো বিচারক যখন আমার কোনো গ্রন্থের সমালোচনা করেন তখন প্রথার খাতিরে ঔদাসীন্যের ভান করা আমার দ্বারা হইয়া উঠে না । “সাহিত্যের দিক দিয়া আপনি অচলায়তনের উপর যে রায় লিখিয়াছেন তাহার বিরুদ্ধে আপনার নিকট আমি কোনো আপিল রুজু করিব না। আপনি যে ডিগ্ৰী দিয়াছেন সে আমার যথেষ্ট হইয়াছে । “কিন্তু ওই-যে একটা উদ্দেশ্যের কথা তুলিয়া আমার উপরে একটা মস্ত অপরাধ চাপাইয়াছেন সেটা আমি চুপচাপ করিয়া মানিয়া লইতে পারিব না । কেবলমাত্র ঝোক দিয়া পড়ার দ্বারা বাক্যের অর্থ দুই-তিন-রকম হইতে পারে । কোনো কাব্য বা নাটকের উদ্দেশ্যটা সাহিত্যিক বা অসাহিত্যিক তাহাও কোনাে কোনাে স্থলে ঝোকের দ্বারা সংশয়াপন্ন হইতে পারে। পাখি পিঞ্জরের বাহিরে যাইবার জন্য ব্যাকুল হইতেছে ইহা কাব্যের কথা, কিন্তু পিঞ্জরের নিন্দা করিয়া খাচাওয়ালার প্রতি খোচা দেওয়া হইতেছে এমনভাবে সুর করিয়াও হয়তো পড়া যাইতে পারে । মুক্তির জন্য পাখির কাতরতাকে ব্যক্ত করিতে হইলে খাচার কথাটা একেবারেই বাদ দিলে চলে না। পাখির বেদনাকে সত্য করিয়া দেখাইতে হইলে খাচার বদ্ধতা ও কঠিনতাকে পরিস্ফুট করিতেই হয় । “জগতের যেখানেই ধর্মকে অভিভূত করিয়া আচার আপনি বড়ো হইয়া উঠে। সেখানেই মানুষের চিত্তকে সে রুদ্ধ করিয়া দেয়, এটা একটা বিশ্বজনীন সত্য । সেই রুদ্ধ চিত্তের বেদনাই কাব্যের বিষয়, এবং আনুষঙ্গিক ভাবে শুষ্ক আচারের কদর্যতা স্বতই সেইসঙ্গে ব্যক্ত হইতে থাকে । ‘ধর্মকে প্রকাশ করিবার জন্য, গতি দিবার জন্যই, আচারের সৃষ্টি ; কিন্তু কালে কালে ধর্ম যখন সেই সমস্ত আচারকে নিয়মসংযমকে অতিক্রম করিয়া বড়ো হইয়া উঠে, অথবা ধর্ম যখন সচল নদীর মতো আপনার ধারাকে অন্য পথে লইয়া যায়, তখন পূর্বতন নিয়মগুলি অচল হইয়া শুষ্ক নদীপথের মতো পড়িয়া থাকে- বস্তুত তখন তাহা তপ্ত মরুভূমি, তৃষাহরা তাপনাশিনী স্রোতস্বিনীর সম্পূর্ণ বিপরীত । সেই শুষ্ক পথটাকেই সনাতন বলিয়া সম্মান করিয়া নদীর ধারার সন্ধান যদি একেবারে পরিত্যাগ করা যায়। তবে মানবাত্মাকে পিপাসিত করিয়া রাখা হয় । সেই পিপাসিত মানবাত্মার ক্ৰন্দন কি সাহিত্যে প্রকাশ করা হইবে না, পাছে পুরাতন নদীপথের প্রতি অনাদর দেখানো হয় ?