পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় Գ ՏՀ» গড়বার কারখানা নয়। এ কথাও কি বোঝাতে হবে । ম্যাকবেথ নাটকে দুটিমাত্র প্রধান পাত্ৰ, ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথ। বলা বাহুল্য, দুজনের কাউকেই সুকুমারমতি পাঠকদের চরিত্রগঠনযোগ্য দৃষ্টান্তরূপে ব্যবহার করা চলবে না। অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিয়োপ্যাট্রা শেকসপীিয়রের প্রধান নাটকের মধ্যে অন্যতম । কিন্তু ক্লিয়োপ্যাট্রা প্ৰাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যাদের মধ্যে স্থান পাবার অধিকারিণী হলেও তাকে সাধবীর আদর্শ বলা চলবে না । আর, অ্যান্টনি আপনি চরিত্রের অনিন্দ্য আদর্শে আধুনিক উচ্চ দরের বাংলা নভেলের নায়কদের সমশ্রেণীভুক্ত নয়, এ কথা মানতেই হবে । তথাপি এও না মেনে চলবে না যে, শেকসপীিয়রের নাটকটি উচুদরের বাংলা নভেলের চেয়ে অন্তত কোনো অংশে হীন নয়। মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রকে তুচ্ছ করতে পারি নে, কিন্তু মহত্ত্বে র্তার ন্যূনতা ছিল। কারই বা না ছিল ? স্বয়ম্বরসভার ব্যাপারে ভীষ্মই কি ক্ষমার যোগ্য । এমন-কি, কবির প্রিয়পাত্ৰ পাণ্ডবদের আচরণে কলঙ্ক খুঁজে বের করবার জন্যে অধিক তীক্ষ দৃষ্টির প্রয়োজন হয় না । আধুনিক বাংলাদেশে বেদব্যাস জন্মান নি, সে তার পুণ্যফলে । অপর পক্ষ থেকে তর্ক করতে পারেন যে, সাহিত্যে সমাজধর্ম ও শাশ্বতধর্মের ত্রুটি দেখা দেয়, তার শোকাবহ পরিণাম প্রমাণ করবার জন্যেই। অর্থাৎ, এইটুকু দেখাবার জন্যে যে স্থলনের পথ আরামের পথ নয় । কিন্তু দেখতে পাই, আজকাল তাতেও ভালোমানুষ লোকের ক্ষোভ-শান্তি হয় না। “ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে সন্দীপ বা বিমলা গৌরবজনক সিদ্ধিলাভ করে নি, কিন্তু তবু লেখক সেদিন সমালোচকের দরবারে দণ্ড থেকে অব্যাহতি পেলেন না । তারস্বরে ফরমাশ এই যে, যেমন করেই হােক, শ্রেষ্ঠ আদর্শ রচনা করতেই হবে । ছেলেমানুষি আবদার একেই বলে, যে চায় লালায়িত রসনা দিয়ে কেবলই চিনির পুতুল লেহন করতে । ‘দুই বোন গল্পটা সম্বন্ধে আমার নিজের ব্যাখ্যা কিছু শুনতে চেয়েছ। গল্পের ভূমিকাতেই ভিতরের কথাটা ফাস করে দিয়েছি। সাধারণত মেয়েরা পুরুষের সম্বন্ধে কেউ বা মা, কেউ বা প্রিয়া, কেউ বা দুইয়ের মিশেল। বাংলাদেশে অনেক পুরুষ আছে যারা বৃদ্ধ বয়স পর্যন্তই । মাতৃ-অঙ্কের আবহাওয়ায় সুরক্ষিত । তারা স্ত্রীর কাছে মায়ের লালনটাই উপভোগ্য বলে জানে । বিবাহে যাবার আগে বর বলে যায়, মা, তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি। অর্থাৎ স্ত্রী আসে মায়ের পরিশিষ্ট হয়ে- Alma Mater-এর পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্রীর মতোই। ছেলে মায়ের কাছ থেকে আশৈশব যে-সকল সেবায় অভ্যস্ত বধু এসে তারই অনুবৃত্তিতে দীক্ষিত হয় । অল্প স্ত্রীই এমন সুযোগ পায় যাতে নিজের স্বতন্ত্র রীতিতেই স্বামীর পূর্ণতা সাধন করতে পারে, সংসারকে সম্পূর্ণ আপন প্রতিভায় নূতন করে তোলে। আবার এমন পুরুষও নিশ্চয়ই আছে যারা আদ্ৰ আদরের আবেশে আপাদমস্তক আচ্ছন্ন থাকতে ভালোই বাসে না । তারা স্ত্রীকে চায় স্ত্রীরূপেই, তারা চায় যুগলের অনুসঙ্গ । তারা জানে স্ত্রী যেখানে যথার্থ স্ত্রী, পুরুষ সেখানেই যথার্থ পৌরুষের অবকাশ পায়। নইলে তাকে লালনরসলালায়িত শিশুগিরি করতে হয় । মায়ের দাসীকে নিয়ে থাকার মতো এমন দৌর্বল্য পুরুষের জীবনে আর কিছু নেই। শশাঙ্ক স্ত্রীর মধ্যে নিত্যস্নেহসতর্ক মাকে পেয়েছিল । তাই তার অন্তর ছিল অপরিতৃপ্ত । এমন অবস্থায় উমি তার কক্ষপথে এসে পড়াতে সংঘাত লাগল, ট্র্যাজেডি ঘটল । অপর পক্ষে অতিনির্ভরলোলুপ মেয়ে সংসারে অনেক আছে। তারা এমন পুরুষকে চায় যারা হবে তাদের প্ৰাণ যাত্রার মোটর-রথের শোফার । তারা চায় পতিগুরুকে, পদধূলির কাঙালিনী তারা । কিন্তু যাকে পেলে তার নারীত্ব প্ৰতিপূর্ণ হয় । দৈবক্রমে উর্মি সেই জাতের। শুরুতেই চালককে নিয়ে, শুরুকে নিয়ে, তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল। ঠিক সেই সময়ে সে এমন পুরুষকে পেলে যার চিত্ত নিজের অজ্ঞাতসারে খুঁজছিল স্ত্রীকেই। যার সঙ্গে তার লীলা সম্ভব আপন জীবনের সমভূমিতেই, যে তার যথার্থ জুড়ি । । - .