পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bro SR রবীন্দ্র-রচনাবলী যে-আর্যগণ অতঃপর অনার্যগণের সহিত মিশিয়া প্রতিলোম বিবাহে এবং অনার্যচরিত বিবিধ আচারধর্ম দেবতা ও পূজা প্ৰণালী গ্রহণে তাহাদিগকে সমাজান্তৰ্গত করিয়া লইয়া বৈদিক সমাজের সম্পূর্ণ বিরোধী আধুনিক সমাজকে গঠিত করিয়া তুলিয়াছিলেন, হিন্দুর আত্মঘাতী গৃহবিবাদের অবকাশে যে মুসলমান এ দেশে আসিয়া বংশপরম্পরাক্রমে জন্মমৃত্যু দ্বারা এ দেশের মাটিকে আপনার করিয়া লইল- ভারতের ইতিহাস। ইহাদের মধ্যে কাহার - স্বতন্ত্র কাহারও নহে । তবে সে কি হিন্দু-মুসলমানের । তাহাও নহে। সংকীর্ণতার গণ্ডি দিয়া ইহাকে বাধিতে যাওয়া শুধু আমাদের অহংকার প্রকাশ করা মাত্র । ভারতবর্ষ কাহারও নিজস্ব সম্পত্তি নহে, এবং একদিন যে কোনো-এক বিশিষ্ট জাতি তাহার ইতিহাস। যে মহান সত্য নানা আঘাত-সংঘাতের মধ্য দিয়া পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে, আমাদিগকে তাহারই সাহায্য করিতে হইবে । ব্যক্তিবিশেষ বা সমাজবিশেষের কর্তৃত্বলাভের চেষ্টায় মর্যাদা কিছু নাই। ভারতবর্ষকে একটি অপূর্ব পরিপূর্ণকারে গড়িয়া তুলিতে হইবে । আমরা তাহার একটি উদাহরণমাত্র এ কথা যেন মনে রাখি। আমরা যদি দূরে দূরে থাকি বা নিজের স্বাতন্ত্র্যে খণ্ডাকারে প্রকাশিত হইতে চাই- সে নিবুদ্ধিতার জন্য আমরাই দায়ী । আমরা যেটুকু মিলিতে পারিব সেইটুকুই সার্থক হইবে । যেটুকু গণ্ডিবদ্ধ সেটুকু নিরর্থক, এবং তাহার নাশ অবশ্যম্ভাবী । আজ যে পশ্চিম হইতে ইংরেজ আসিয়া ভারতেতিহাসের একটা প্রধান অংশ জুড়িয়া বসিয়াছে ইহা কি সম্পূর্ণ আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়। ইংরেজের নিকট কি আজ আমাদের শিখিবার কিছুই নাই । তিন সহস্ৰ বৎসর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষগণ যাহা আমাদের দিয়া গিয়াছেন, বিশ্বমানব-ভাণ্ডারে তাহা অপেক্ষা নূতন জ্ঞান কি আর কিছুই থাকিতে পারে না । নিখিলমানবের সঙ্গে জ্ঞান প্ৰেম কর্মের নানা আদানপ্রদানে আমাদের অনেক প্রয়োজন আছে ; ইংরেজ বিধাতৃপ্রণোদিত হইয়া তাহারই উদ্যম আমাদের মধ্যে জাগাইতে আসিয়াছে— সফল না। হওয়া পর্যন্ত সে নিশ্চিন্ত হইবে না। সে সফলতা পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনে, বিরোধে নহে। ভারতবর্ষ হইতে অসময়ে ইংরেজকে তাড়াইবার আমাদের অধিকার ? আমরাই বা কাহারা - হিন্দু না মুসলমান ? বাঙালি না। মারাঠি না পাঞ্জাবি ? যাহারা— যে সম্মিলিত সমষ্টি- একদিন সম্পূর্ণ সত্যের সহিত “আমরাই ভারতবর্ষ এ কথা বলিতে পরিবে, এ অহংকার তাহাদের মুখে শোভা পাইবে । আজ মহাভারতবর্ষ গঠনের ভার আমাদের উপর । সমুদয় শ্রেষ্ঠ উপকরণ লইয়া আজ আমাদের এক মহাসম্পূর্ণতাকে গঠিত করিয়া তুলিতে হইবে । গণ্ডিবদ্ধ থাকিয়া ভারতের ইতিহাসকে যেন আমরা দরিদ্র করিয়া না তুলি । ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ অধুনাতন মনীষিগণ এ কথা বুঝিয়াছিলেন, তাই তাহারা প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্যকে মিলাইয়া কাৰ্য করিয়া গিয়াছেন । দৃষ্টান্তস্বরূপ রামমোহন রায়, রানাডে এবং বিবেকানন্দের নাম করিতে পারি। ইহারা প্রত্যেকেই প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাধনাকে একীভূত করিতে চাহিয়াছেন ; ইহারা বুঝাইয়াছেন যে, জ্ঞান শুধু এক দেশ বা জাতির মধ্যে আবদ্ধ নহে ; পৃথিবীর যে-দেশেই যে-কেহ জ্ঞানকে মুক্ত করিয়াছেন, জড়ত্বের শৃঙ্খল মোচন করিয়া মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে উন্মুখ করিয়া দিয়াছেন তিনিই আমাদের আপন— তিনি ভারতের ঋষি হউন বা প্রতীচ্যের মনীষী হউন- তাহাকে লইয়া আমরা মানবমাত্রেই ধন্য । বঙ্কিমচন্দ্ৰও অসীম প্রতিভাবলে বাংলাসাহিত্যে পশ্চিম এবং পূর্বের মিলন সাধন করিয়া বঙ্গসাহিত্যকে পূর্ণ পরিণতির পথে অগ্রসর করাইয়া, কম সার্থক করিয়া তোলেন নাই । ] অতএব, আজ আমাদের এই মিলনের সাধনা করিতে হইবে ; রাজনৈতিক, বললাভের জন্য নহে, মনুষ্যত্ব লাভের জন্য ; স্বাৰ্থ বুদ্ধির পথ দিয়া নহে, ধর্মবুদ্ধির মধ্য দিয়া । ]