পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় K brovo কিন্তু আজ এই মিলনের পথে যে-বিরোধ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, ইহা কি মিলনের পক্ষে সম্পূর্ণ প্রতিকুল । তাহা নহে। আমাদের ভক্তিতত্ত্বে বিরোধও মিলনসাধনার একটা অঙ্গস্বরূপ । কারণ, অসত্যকে অবলম্বন করিয়া সত্যের নিকট যে পরাজয়, তাহার মতো স্থায়ী লাভ আর নাই। অসংশয়ে বিনা বিচারে যাহা গ্ৰহণ করিলাম, তাহাতে আমার প্রতিষ্ঠা থাকে কোথায় । । আজ আমরা আমাদের জীবনের মাঝে এক অবমাননার বেদনা অনুভব করিতেছি । এতদিন আমরা নিজের মর্যাদার প্রতি লক্ষ না রাখিয়া শুধুই অপরের দান গ্ৰহণ করিয়া আসিতেছিলাম । আত্মমর্যাদার প্রস্তরে ঘষিয়া তাহার মূল্য যাচাই করিয়া তাহাকে আপনার করিয়া লইতে এত দিন পারি নাই। কাজে, কাজেই সে দান আমাদের অস্তরে মিশিতে পায় নাই, তাহা শুধু বাহিরের - পোশাকি জিনিস হইয়া উঠিতেছিল। সে যে দান নহে, সে যে শুধু অপমান, আজ তাহা আমরা আমাদের ক্ষুন্ন মর্যাদায় স্পষ্টই উপলব্ধি করিতেছি এবং এই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার প্রভাবেই আজ । যত বিরোধ উপস্থিত হইতেছে । আপনার মর্যাদায় দণ্ডায়মান হইয়া যেদিন অপরের দান লাইতে পারিব সেইদিন সে-গ্ৰহণে সার্থকতা, কারণ তাহাতে নীচতা নাই- সে-দান তখন আমাদের অন্তরাত্মার সহিত যথার্থ মিশিয়া আমাদের এই অতৃপ্তি অশান্তি বিদূরিত করিতে সমর্থ হইবে । মহাত্মা রামমোহন দীনের ন্যায় পাশ্চাত্যের চরণতলে উপস্থিত হন নাই, তিনি শুধু প্রতীচ্যের জ্ঞানে আপনার জ্ঞানের অসম্পূর্ণতাটুকুকে পূর্ণ করিতে চাহিয়াছিলেন মাত্র । এবং সেইজন্যই তিনি প্রাচ্যের জ্ঞােনরত্নভাণ্ডার-দ্বারে দাড়াইয়া গর্বের সহিত প্রতীচ্যের মুক্তারাজি আহরণ করিয়া তাহাদিগকে যথার্থ আপনার করিয়া তুলিতে পারিয়াছিলেন । আসল কথা এই পশ্চিমের সহিত প্ৰাচ্যকে মিলিতেই হইবে । পশ্চিমকে আপনার শক্তিতে আপনার করিয়া লইতেই হইবে । আমাদের যদি আত্মশক্তির অভাব ঘটে বা পশ্চিম যদি আপনাকে সত্যভাবে প্রকাশ করিতে কৃপণতা করে— উভয়ই ক্ষোভের বিষয় । অধুনা ইংরেজ, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ তাহার পূর্বতন মনীষিগণের ন্যায়, তাহার ইংরেজি সভ্যতার পূর্ণ অভিব্যক্তির পরিচয় আমাদিগকে দিতেছে না ; এবং সেইজন্যই পূর্বকালের ছাত্রসম্প্রদায়ের ন্যায় আধুনিক ছাত্ৰগণের শেকসপীয়র বা বায়রনের কাব্যপাঠে সে আন্তরিক অনুরাগ আর নাই ; সাহিত্যের মধ্য দিয়া ইংরেজের সহিত যে-মিলন তখন ফুটিয়া উঠিতেছিল, আজ তাহা প্ৰতিহত হইয়া পড়িয়াছে। তাহার যাহা শ্রেষ্ঠ, যাহা সত্য, তাহা হইতে ইংরেজ আজ আমাদিগকে স্বেচ্ছায় দূরে রাখিতেছে ; এমত অবস্থায় যদি স্বভাবতই মিলন না আসে। তবে প্রবল সিডিশনের আইন করিয়া দুর্বল আমাদিগকে বাধিয়া রাখা, অসন্তোষ বৃদ্ধি করা মাত্র- দূর করা নহে। সুশাসন এবং ভালো আইন মানুষের চরম লাভ নহে ; মানুষ মানুষকে চায়, মানুষ হৃদয়কে চায় ; তাহা যদি সে । না পায় সে কিছুতেই তৃপ্ত হইতে পারে না । কিন্তু এ কথা আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে, দীনতার নিকটেই হীনতা ধরা পড়ে-- শক্তির । নিকটেই যথার্থ মর্যাদা প্ৰকাশ পায় ; অতএব সকল দিকেই আমাদিগকে শক্তিশালী হইতে হইবে । আমাদিগের সকল দাবিই আমাদিগকে জয় করিয়া লইতে হইবে- হীনতার দ্বারা নহে, কিন্তু মহত্ত্বের দ্বারা, মনুষ্যত্বের দ্বারা। “নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ”- দুর্বল পরমাত্মাকে জানিতে পারে না ; দেবতাকে যে চাহে তাহাকে দেবগুণোচিত প্রকৃতিসম্পন্ন হইতে হইবে । তীব্ৰ উক্তির দ্বারা নহে, দুঃসাহসিক কার্যের দ্বারা নহে, কিন্তু ত্যাগের দ্বারা আজ আমাদিগকে শ্রেয়কে বরণ করিয়া লইতে হইবে । যখন আমরা নিজের চেষ্টা দ্বারা, নিজের ত্যাগের দ্বারা, দেশকে আপনি করিয়া লইতে এবং দেশের উপর আমাদের সত্য অধিকার স্থাপন করিতে পারিব- তখন আর আমরা দীন নাই, আমরা তখন ইংরেজের সহযোগী । আমাদের দীনতার অভাবে তখন ইংরেজেরও আর হীনতা প্রকাশ পাইবে না। ভারত আজ। আপনার মুঢ়তায় শাস্ত্ৰে ধর্মসমাজে কেবলই আপনাকে বঞ্চনা ও অপমান করিতেছে । সত্যের দ্বারা ত্যাগের দ্বারা আজ