পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় । trSS সমাসঘটাচ্ছন্ন ভাষাও কোনােদিন বাংলাভাষার আদর্শ হইয়া দাড়াইবে না বা কেবল হুতোমী ভাষাও সকলের নিকট গ্রাহ্য হইবে না। তা কোনো দেশেই হয় না। একসময়ে ইংলন্ডে Anglo Saxon –দিগের মধ্যে ল্যাটিন শব্দ লওয়ার আপত্তি হইয়াছিল। কিন্তু তাহা টিকিল না । অনেক ল্যাটিন শুব্দ ঢুকিয়া পড়িল । তাহার, অনেক আছে, অনেক গিয়াছে। এত পাকাপাকির মধ্যেও অনেক রহিয়া গিয়াছে। বাংলাভাষায় সে অবস্থা হয় নাই। সমস্ত সংস্কৃত শব্দ হজম করিয়া ইহা চলিতে পারে না । বাংলাভাষায় অনেক বিষয়ের শব্দ নাই ; সে-সকল নাই। তাহার কারণ এই, ভাষায় যে-সকল কথা বলিবার আবশ্যক কোনোদিন হয় নাই সুতরাং সে-সকল বিষয় বলিতে গেলে অপর ভাষার নিকট ঋণী হইতেই হইবে। আবার বাংলাভাষায় কতকগুলি সংস্কৃতের অপভ্ৰষ্ট শব্দের এমন ভিন্নার্থ দাড়াইয়া গিয়াছে যে, সেগুলির সেই অর্থ বাদ দিলে বাংলাভাষায় শব্দাভাব ঘটিবে। সংস্কৃত ‘ঘুণা’ বাংলায় ‘ঘেন্না’ হইয়াছে কিন্তু তাহাতে ‘ঘুণা’র অর্থ বজায় নাই। “পিরীতি’ শব্দে ‘গ্ৰীতি’র অর্থ নাই। কাজেই এ-সকল শব্দের মূলানুসন্ধান না করিলে বিশেষ ফল কী হইবে । এইরূপ অৰ্থান্তর দেখিয়া মনে হয় অপ্রকাশিত গ্ৰন্থরাশি প্রকাশিত হইলে, আমাদের বাংলা শব্দভাণ্ডার অপূর্ণ থাকিবে না । খাটি বাংলা শব্দ লইয়াই সকল ভাব প্ৰকাশ করা যাইতে পারে । বাংলা শব্দের বানান লইয়া যে দাড়ি টানিবার কথা উঠিয়াছে সে সম্বন্ধে আমি এই পর্যন্ত বলি, আমি কিছুই পাকাপাকি করিয়া দিই নাই। এ সম্বন্ধে আমা অপেক্ষা দীনেশবাবু ভালো বলিতে পারেন, কত প্ৰাচীন কাল হইতে কোন শব্দের কী বানান লেখা চলিয়া আসিতেছে। আমার মনে হয় যখন “শ্রবণ” হইতে ‘শোনা লিখিবার সময় “ন’ লেখা হয়, মূর্ধন্য ‘ণ লিখিলে ভুল হয় তখন “স্বর্ণ হইতে ‘সোনা” যদি “ন’ দিয়া লিখি তবে ভুল কেন হইবে । এই সকল বিষয় বিবেচনা করিয়া বাংলা ব্যাকরণের বিষয় মীমাংসা করা আবশ্যক । আমি যাহা বলিয়াছি তাহা যে অপরিবর্তনীয়, তাহাই যে সর্বথা গ্রাহ্য, এ কথা যেন কেহ মনে না করেন । আমি উপকরণ সংগ্ৰহ করিয়া দিতেছি, আপনারা দেশের পণ্ডিতবর্গ তাহার ব্যবহার করুন, বাংলা ব্যাকরণ কিরূপ হইবে তাহা স্থির করুন । সভাপতি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার বক্তব্যে বলেন : - শ্ৰীমান রবীন্দ্রনাথ যে-শব্দ রাশি সংগ্ৰহ করিয়াছেন।” তাহাদের ব্যবহার ও গঠন সম্বন্ধে নিয়মাদি বাংলা ব্যাকরণে থাকা আবশ্যক। যাহারা এগুলি Slangবলিয়া অশ্রদ্ধা করেন তাহারা বাংলাভাষার একাংশ বাদ দিতে চাহেন ।••• শরচ্চন্দ্ৰ শাস্ত্রী মহাশয় রবীন্দ্রনাথের এই প্ৰবন্ধের প্রতিবাদে পরিষদের অষ্টম মাসিক অধিবেশনে (২৮ পৌষ ১৩০৮) “ব্যাকরণ ও বাংলাভাষা’ নামক এক প্ৰবন্ধ পাঠ করেন ।** আলোচনার শেষে সভাপতি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন : শ্ৰীমান রবীন্দ্রনাথ কতকগুলি বাংলা প্রত্যয়ের উদাহরণ সংগ্ৰহ করিয়া দিয়াছেন, তাহাতে ভুল নাই, এ কথা তিনিও বলেন না । তাহাতে দুটা-একটা ভুল যে না আছে তাহীও নহে। সংস্কৃত অভিধান ও ব্যাকরণের অন্তৰ্গত শব্দসমষ্টি ছাড়া ভাষার আর-একটি দিক যে আছে, তাহা দেখাইয়া দেওয়া তাহার উদ্দেশ্য ।--- প্ৰত্যয়াদির রূপ রবীন্দ্ৰ যাহা স্থির করিয়াছেন তাহাই হউক, আর অন্যরূপই হউক, তাহাতে বড়ো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। তাহা আলোচনার মুখে স্থির হইবে । ১৩১১ সালে পরিষদের প্রথম বিশেষ অধিবেশনে (১৪ জ্যৈষ্ঠ) রবীন্দ্রনাথ-কর্তৃক “ভাষার ইঙ্গিত প্ৰবন্ধটি পাঠের পর যে-আলোচনা হয় তাহাতে সভায় উপস্থিত ব্যক্তিগণের মধ্যে ৩১ দ্রষ্টব্য ধ্বন্যািত্মক শব্দ, বাংলা কৃৎ ও তন্ধিত, বাংলাক্রিয়াপদের তালিকা ; রবীন্দ্র-রচনাবলী, বর্তমান খণ্ড (প্রচলিত দ্বাদশ খণ্ড) । ৩২। ব্যাকরণ ও বাংলাভাষা- ভারতী, ফায়ুন ১৩০৮ ।