পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ృ8 সুন্দর পশ্চিম আকাশের পারে তখনও স্বর্যাস্তের ধুসর আভা ছিল ; আমাদের আশ্রমে শালবনের মাথার উপরে সন্ধ্যাবেলাকার নিস্তব্ধ ,শান্তি সমস্ত বাতাসকে গভীর করে তুলছিল। আমার হৃদয় একটি বৃহৎ সৌন্দর্যের আবির্ভাবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। আমার কাছে বর্তমান মুহূর্ত তার সীমা হারিয়ে ফেলেছিল ; আজকেকার এই সন্ধ্যা কত যুগের স্থদুর অতীতকালের সন্ধ্যার মধ্যে প্রসারিত হয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে যেদিন ঋষিদের আশ্রম সত্য ছিল, যেদিন প্রত্যহ সূর্যের উদয় এ দেশে তপোবনের পর তপোবনে পাখির কাকলি এবং সামগানকে জাগিয়ে তুলত, এবং দিনের অবসানে পাটলবর্ণ নিঃশব্দ গোধূলি কত নদীর তীরে কত শৈলপদমূলে শ্রাস্ত হোমধেনুগুলিকে তপোবনের গোষ্ঠগৃহে ফিরিয়ে আনত, ভারতবর্ষের সেই সরল জীবন এবং গভীর সাধনার দিন আজকের শাস্ত সন্ধ্যার আকাশে অত্যন্ত সত্যরূপে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছিল। আমার এই কথা মনে হচ্ছিল, আর্যাবর্তের দিগস্তপ্রসারিত সমতল ভূমিতে সূর্যোদয়ে ও স্বর্যাস্তে যে আশ্চর্য সৌন্দর্যের মহিমা প্রতিদিন প্রকাশিত হয় আমাদের আর্যপিতামহেরা তাকে এক দিনও এক বেলাও উপেক্ষা করেন নি। প্রাতঃসন্ধ্যা ও সায়ংসন্ধ্যাকে তারা অচেতনে বিদায় দিতে পারেন নি। প্রত্যেক যোগী এবং প্রত্যেক গৃহী তাকে হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু, কেবল ভোগীর মতো নয়, ভাবুকের মতো নয়। সৌন্দর্যকে তারা পূজার মন্দিরে অভ্যর্থনা করে নিয়েছেন । সৌন্দর্যের মধ্যে যে আনন্দ প্রকাশ পায় তাকে তারা ভক্তির চক্ষে দেখেছেন ; সমস্ত চাঞ্চল্য দমন করে মনকে স্থির শাস্ত করে উষা ও সন্ধ্যাকে তারা অনন্তের ধ্যানের সঙ্গে মিলিত করে নিয়েছেন। আমার মনে হল, নদীসংগমে সমুদ্রতীরে পর্বতশিখরে যেখানে তারা প্রকৃতির স্বন্দর প্রকাশকে বিশেষ করে দেখেছেন সেইখানে তারা আপনার ভোগের উষ্ঠান রচনা করেন নি ; সেখানে তারা এমন একটি তীর্থস্থান স্থাপন করেছেন, এমন কোনোএকটি চিহ্ন রেখে দিয়েছেন, যাতে স্বভাবতই সেই স্বন্দরের মধ্যে ভূমার সঙ্গে মামুষের মিলন হতে পারে। এই স্বন্দরের মহান রূপকে সহজ দৃষ্টিতে যেন প্রত্যক্ষ করতে পারি, এই প্রার্থনাটি আমার মনের মধ্যে সেই সন্ধ্যার আকাশে জেগে উঠছিল। জগতের মধ্যে সুন্দরকে