পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৬২ * রবীন্দ্র-রচনাবলী হয় না— চলার পথে উৎসব, চলতে চলতে উৎসব। এ উৎসব কবে আরম্ভ হয়েছে। যেদিন এই পৃথিবীতে মায়ের কোলে জন্মগ্রহণ করেছি সেই দিন থেকে এই আনন্দউৎসবের আমন্ত্রণ পৌচেছে ; সেই আহানে সেই দিন থেকে পথে বেরিয়েছি । সেই যাত্রীর সঙ্গে সেই দিন থেকে তুমি যে সহযাত্রী, তাই তো যাত্রীর উৎসব জমেছে। মনে হয়েছিল ষে পথে চলেছি সে সংসারের পথ – তার মাঝে সংসার, তার শেষে সংসার ; তার লক্ষ্য ধনমান, তার অবসান মৃত্যুতে । কিন্তু না, পথ তো কোথাও ঠেকে না, সমস্তকেই যে ছাড়িয়ে যায়। তুমি সহযাত্রী তার দক্ষিণ-হাত ধরে কত সংকটের মধ্য দিয়ে, সংশয়ের মধ্য দিয়ে, সংগ্রামের ভিতর দিয়ে, তাকে পাশে নিয়ে চলেইছ ; কোনো-কিছুতে এসে থামতে দাও নি। সে বিদ্রুপ করেছে, বিরুদ্ধতা করেছে, কিন্তু তুমি তার দক্ষিণ হাত ছাড় নি। তুমি সঙ্গে সঙ্গে চলেছ ; তুমি তাকে উত্তীর্ণ করে দিয়েছ সেই অনন্ত মনুষ্যত্বের বিরাট রাজপথে, সেখানে সমস্ত যাত্রীর দল চিরজীবনের তীর্থে চলেছে। ইতিহাসের সেই প্রশস্ত রাজপথে কী আনন্দকোলাহল, কী জয়ধ্বনি ! সেই তো উৎসবের আনন্দধ্বনি! তুমি বদ্ধ কর নি, তুমি বদ্ধ হতে দেবে না, তুমি কোনো মতের মধ্যে প্রথার মধ্যে মানুষকে নজরবন্দী করে রাখবে না। তুমি বলেছ, মাভৈঃ, যাত্রীর দল বেরিয়ে পড়ে। কেন ভয় নেই। কিসে নির্ভয় । তুমি যে সঙ্গে সঙ্গে চলছ । তাই তো যে চলছে সে কেবলই তোমাকে পাচ্ছে। যে চলছে না সে আপনাকেই পাচ্ছে, আপনার সম্প্রদায়কেই পাচ্ছে। অনন্তকাল যিনি আকাশে পথ দেখিয়ে চলেছেন তিনি কবে চলবে বলে কারও জন্যে অপেক্ষা করবেন না । যে বসে রয়েছে সে কি দেখতে পাচ্ছে না তার বন্ধন । সে কি জানে না যে এই বন্ধন না খুলে ফেললে সে মুক্ত হবে না, সে সত্যকে পাবে না। সত্যকে বেঁধেছি, সত্যকে সম্প্রদায়ের কারাগারে বন্দী করেছি এমন কথা কে বলে ! অনন্ত সত্যকে বন্দী করবে ? তুমি যত বড়ো মুগ্ধ হও-না কেন, তোমার মোহ-অন্ধকারের জাল বুনিয়ে বুনিয়ে অনন্ত সত্যকে ঘিরে ফেলবে এত বড়ো স্পর্ধার কথা কোন সম্প্রদায় উচ্চারণ করতে পারে! সত্যকে হাজার হাজার বৎসর ধরে বেঁধে আচল করে রেখে দিয়েছি, এই বলে অমর গৌরব করে থাকি। সত্যকে পথ চলতে বাধা দিয়েছি— তাকে বলেছি, তোমার আসন এইটুকুর মধ্যে, এর বাহিরে নয়, তুমি গণ্ডি ডিঙিয়ে না, তুমি সমুদ্র পেরিয়ো না। সত্যের অভিভাবক আমি, আমি তাকে মিথ্যার বেড়ার মধ্যে খাড়া দাড় করিয়ে রাখব— মুগ্ধদের জন্য সত্যের সঙ্গে মিথ্যাকে যে পরিমাণে মেশানো দরকার সেই মেশানোর ভার আমার উপর— এমন সব স্পর্ধাবাকা আমরা এতদিন