পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী و هاه বোধি। কিন্তু, আমার বোধের মধ্যে তো তোমার আবির্ভাব হয় নি। সেই বোধের অপেক্ষায়, আমার উদবোধনের অপেক্ষায় যে র্তাকে থাকতে হয়। যেদিন আমার বোধের মধ্যে পিতারূপে র্তার আবির্ভাব হবে সেদিন পৃথিবীতে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠবে। ভক্তের চৈতন্তে সেদিন যে র্তার নবজন্মলাভ । সংসারের মুখে দুঃখে যখন তরঙ্গায়িত হচ্ছি চৈতন্যের মধ্যে তখন আমরা পিতৃহারা । জীবধাত্রী বস্থঙ্কর পিতার সিংহাসন বহন করছে ; প্রাণের ভাণ্ডার, অল্পের ভাণ্ডার সেখানে পরিপূর্ণ। কিন্তু, অস্তরে যে দুর্ভিক্ষ, সেখানে যে পিতা নেই। সে বড়ো দৈন্য, সে পরম দারিদ্র্য। যিনি রয়েছেন সর্বত্রই, তাকে আমি পাই না। পাই না, কারণ ভক্তি নেই। যুক্তি খুজে পাওয়া সহজ, কিন্তু ভক্তি খুজে পাওয়া যায় না। আনন্দ সহজ না হলে পাওয়া যায় না। উপনিষদে বলে, মন বাক্য তাকে না পেয়ে ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু র্তার আনন্দ যে পেয়েছে তার আর ভয় নেই। র্তাকে দেখা উৎসবের মধ্যে দেখা ; জ্ঞানে নয়, তর্কের মধ্যে নয়। আনন্দের ভিতর দিয়ে ছাড়া কিছুই পাবার উপায় নেই। এই-যে উৎসবের আলোক জলছে একে কি তর্ক করে কোনোমতেই পাওয়া যেত। চোখের মধ্যে আলো পাবার আনন্দ আছে, তাই তো চোখ আলো পায় ; চোখ যে আলোর জন্য লালায়িত। এক সময়ে জীবের তো চক্ষু ছিল না ; চক্ষু কেমন করে ক্রমে জীবের অভিব্যক্তিতে ফুটল ? জীবের মধ্যে আলোককে পাবার তৃষ্ণা ছিল, দেহীর দেহের পর্দার আড়ালে বিরহীর মতে সেই তৃষ্ণা জেগে ছিল ; তার সেই দীর্ঘ বিরহের তপস্যা সহসা একদিন চক্ষুবাতায়নের ভিতরে সার্থক হল । আলোকের আনন্দদূত তার চোখের বাতায়নে এল। আলোককে পাবার আনন্দের জন্য তপস্যা ছিল ; সেই তপস্যা অন্ধ জীবের অন্ধকার দেহের মধ্যে চক্ষুকে বিকশিত করে স্বর্গের আলোকের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে। সেই একই সাধনা অন্ধ চৈতন্তের মধ্যে রয়েছে ; আত্মা কঁদিছে সেখানে। যতদিন পর্যন্ত অন্ধ জীব চক্ষু পায় নি সে জানত না তার ভিতরে আলোকবিরহী কাদছিল ; সে না জানলেও সেই কান্না ছিল বলেই চোখ খুলেছে। অস্তরের মধ্যে চৈতন্যগুহায় অন্ধকারে পরমজ্যোতির জন্য মানুষের তপস্যা চলেছে। এ কথা কখনোই সত্য নয় যে কোনো মানুষের আত্মা ধনজনের জন্য লালায়িত। মগ্নচৈতন্তের অন্ধকারময় রুদ্ধ বাতায়নে বিরহী আত্মা কঁদিছে ; সেই কান্না সমস্ত কোলাহলের আবরণ ভেদ করে নক্ষত্ৰলোক পর্যস্ত উঠেছে । আনন্দ যেদিন আসবে সেদিন চোখ মেলে দেখব সেই জ্যোতির্ময়কে । সেদিন তিনি আমার ভবনে আসবেন এবং বিশ্বভুবনে তার সাড়া পড়ে যাবে। ৭ পৌষ ১৩২১ মাঘ ১৩২১