পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sలి8. রবীন্দ্র-রচনাবলী সরলা। তোমার সঙ্গে কথার খেলা করি এমন ওস্তাদী নেই আমার । । রমেন। কথার দরকার কিসের? পুরুষপাখিই গান করে, তোমরা মেয়েপাখি চুপ করে শুনলেই উত্তর দেওয়া হল। এইবার বসতে দাও পাশে। । পাশে এসে বসলে। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল দুই জনেই। সরলা। রমেনদা, জেলে যাওয়া যায় কী করে, পরামর্শ দাও আমাকে। রমেন। জেলে যাবার রাস্তা এত অসংখ্য এবং আজকাল এত সহজ যে কী করে জেলে না। যাওয়া যায়। সেই পরামর্শই কঠিন হয়ে উঠল। এ যুগে গোরার বাঁশি ঘরে টিকতে দিল না। সরলা। না, আমি ঠাট্টা করছি নে, অনেক ভেবে দেখলুম। আমার মুক্তি ঐখানেই। রমেন। ভালো করে খুলে বলে তোমার মনের কথাটা। সরলা। বলছি সব কথা। সম্পূর্ণ বুঝতে পারতে যদি আদিৎদার মুখখানা দেখতে পেতে । রমেন।। আভাসে কিছু দেখেছি। সরলা। আজ বিকেলবেলায় একলা ছিলেম বারান্দায়। আমেরিকা থেকে ফুলগাছের ছবিদেওয়া ক্যাটালগ এসেছে। দেখছিলেম পাতা উলটিয়ে, রোজ বিকেলে সাড়ে চারটার মধ্যে চা খাওয়া সেরে আদিৎদা আমাকে ডেকে নেন বাগানের কাজে। আজ দেখি অনামিনে বেড়াচ্ছেন ঘুরে ঘুরে। মালীরা কাজ করে যাচ্ছে তাকিয়েও দেখছেন না। মনে হল আমার বারান্দার দিকে আসবেন বুঝি, দ্বিধা করে গেলেন ফিরে। আমন শক্ত লম্বা মানুষ, জোরে চলা, জোরে কাজ, সবদিকেই সজাগ দৃষ্টি, কড়া মনিব অথচ মুখে ক্ষমার হাসি ; আজ সেই মানুয্যের সেই চলন নেই, দৃষ্টি নেই বাইরে, কোথায় তলিয়ে আছেন মনের ভিতরে। অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে এলেন কাছে। অন্যদিন হলে তখনি হাতের ঘড়িটা দেখিয়ে বলতেন, সময় হয়েছে, আমিও উঠে পড়তুম | আজ তা না বলে আস্তে আস্তে পাশে চৌকি টেনে নিয়ে বসলেন। বললেন, “ক্যাটালগ দেখছি বুঝি?” আমার হাত থেকে ক্যাটালগ নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগলেন, কিছু যে দেখলেন তা মনে হল না। হঠাৎ একবার আমার মুখের দিকে চাইলেন, যেন পণ করলেন আর দেরি না করে এখনি কী একটা বলাই চাই। আবার তখনি পাতার দিকে চোখ নামিয়ে বললেন, “দেখেছি সরি, কত বড়ো ন্যাসটাশিয়াম৷” কণ্ঠে গভীর ক্লান্তি। তার পর অনেকক্ষণ কথা নেই, চলল পাতা ওলটানো। আর-একবার হঠাৎ আমার মুখের দিকে চাইলেন, চেয়েই ধ্যা করে বই বন্ধ করে আমার কোলের উপর ফেলে দিয়ে উঠে পড়লেন। আমি বললেম, “যাবে না বাগানে?” আদিৎদা বললেন, “না গেলেন । রমেন। আদিৎদা তোমাকে কী বলতে এসেছিলেন, কী আন্দাজ করো তুমি। সরলা। বলতে এসেছিলেন, তোমার এক বাগান ভেঙেছে, এবার হুকুম এল তোমার কপালে আর-এক বাগান ভাঙবে । রমেন। তাই যদি ঘটে সরি, তা হলে জেলে যাবার স্বাধীনতা যে আমার থাকবে না। সরলা। (স্নান হেসে) তোমার সে রাস্তা কি আমি বন্ধ করতে পারি ? সম্রাট বাহাদুর স্বয়ং খোলাসা রাখবেন । রমেন। তুমি বৃন্তচু্যত হয়ে পড়ে থাকবে রাস্তায়, আর আমি শিকলে ঝংকার দিতে দিতে চমক লাগিয়ে চলব। জেলখানায়, এ কি কখনো হতে পারে? এখন থেকে তা হলে যে আমাকে এই বয়সে ভালোমানুষ হতে শিখতে হবে। Y