পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WS)\ტVტ রবীন্দ্র-রচনাবলী “যাচ্ছিল' ইত্যাদি। কিন্তু “যেল” “যেয়েছি “যেয়েছিলুমী’ পণ্ডিতদের ঘরেও চলে না। এ স্থলে আমরা বলি গেল।’ গিয়েছি গিয়েছিলুমী’। তারপরে পণ্ডিতেরা এবং বলিয়া এক অদ্ভুত অব্যয় শব্দ ংলার স্কন্ধে চাপাইয়াছেন এখন তাহাকে ঝাড়িয়া ফেলা দায়। অথচ সংস্কৃত বােক্যরীতির সঙ্গে এই শব্দ ব্যবহারের যে মিল আছে তাও তো দেখি না। বরঞ্চ সংস্কৃত ‘অপর’ শব্দের আত্মজ যে ‘আর’ শব্দ সাধারণে ব্যবহার করিয়া থাকে তাহ শুদ্ধারীতিসংগত। বাংলায় ‘ও’ বলিয়া একটা অব্যয় শব্দ আছে তােহা সংস্কৃত অপি শব্দের বাংলা রূপ। ইহা ইংরেজি "and" শব্দের প্রতিশব্দ নহে, too শব্দের প্রতিশব্দ। আমরা বলি আমিও যাব তুমিও যাবে- কিন্তু কখনো বলি না। আমি ও তুমি যাব”। সংস্কৃতের ন্যায় বাংলাতেও আমরা সংযোজক শব্দ ব্যবহার না করিয়া দ্বন্দ্বসমাস ব্যবহার করি। আমরা বলি বিছানা বালিশ মশারি সঙ্গে নিয়ো’। যদি ভিন্ন শ্রেণীীয় পদার্থের প্রসঙ্গ করিতে হয় তবে বলি বিছানা বালিশ মশারি। আর বইয়ের বাক্সটা সঙ্গে নিয়ো”। এর মধ্যে এবং * কিংবা ‘ও’ কোথাও স্থান পায় না। কিন্তু পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার আইনকে আমল দেন নাই। আমি এই যে দৃষ্টান্তগুলি দেখাইতেছি তার মতলব এই যে, পণ্ডিতমশায় যদি সংস্কৃত রীতির উপর ভর দিয়া বাংলারীতিকে অগ্রাহ্য করিতে পারেন, তবে আমরাই যা কেন বাংলারীতির উপর ভর দিয়া যথাস্থানে সংস্কৃত রীতিকে লঙ্ঘন করিতে সংকোচ করি? মনোসাধে আমাদের লজ্জা কিসের ? সাবধানী’ বলিয়া তখনি জিব কাটিতে যাই কেন? এবং “আশ্চর্য হইলাম’ বলিলে পণ্ডিতমশায় “আশ্চর্যান্বিত হয়েন” কী কারণে ? আমি যে-কথাটা বলিতেছিলাম। সে এই-- যখন লেখার ভাবার সঙ্গে মুখের ভাষার অসামঞ্জস্য থাকে তখন স্বভাবের নিয়ম অনুসারেই এই দুই ভাষার মধ্যে কেবলই সামািজস্যের চেষ্টা চলিতে থাকে। ইংরেজি-গদ্যসাহিত্যের প্রথম আরম্ভে অনেকদিন হইতেই এই চেষ্টা চলিতেছিল। আজ তার কথায় লেখায় সামঞ্জস্য ঘটিয়াছে বলিয়াই উভয়ে একটা সাম্যদশায় আসিয়াছে। আমাদের ভাষায় এই অসামঞ্জস্য প্রবল সুতরাং স্বভাব। আপনি উভয়ের ভেদ ঘুচাইবার জন্য ভিতরে ভিতরে আয়োজন করিতেছিল। এমন সময় হঠাৎ আইনকৰ্তার প্রাদুর্ভাব হইল। তারা বলিলেন লেখার ভাষা আজ যেখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে ইহার বেশি আর তার নড়িবার হুকুম নাই। : সবুজ পত্র’ সম্পাদক বলেন বেচারা পুথির ভাষার প্রাণ কঁদিতেছে কথার ভাষার সঙ্গে মালা বদল করিবার জন্য। গুরুজন ইহার প্রতিবাদী। তিনি ঘটকালি করিয়া কৌলীন্যর নির্মম শাসন ভেদ করিকেন এবং শুভ বিবাহ ঘটাইয়া দিবেন- কারণ কথা আছে শুভস্য শীঘ্ৰং।। ১ যাঁরা প্রতিবাদী তীরা এই বলিয়া তর্ক করেন যে, বাংলায় চলিত ভাষা নানা জিলায় নানা ছাঁচের, তবে কি বিদ্রোহীর দল একটা অরাজকতা ঘটাইবার চেষ্টায় আছে! ইহার উত্তর এই যে, যে যেমন খুশি আপন প্রাদেশিক ভাষায় পুথি লিখিবে, চলিত ভাষায় লিখিবার এমন অর্থ নয়। প্রথমত খুশিরও একটা কারণ থাকা চাই। কলিকাতার উপর রাগ করিয়া বীরভূমের লোক বীরভূমের প্রাদেশিক ভাষায় আপন বই লিখিবে এমন খুশিটাই তার স্বভাবত হইবে না। কোনো একজন পাগলের তা হইতেও পারে। কিন্তু পনেরো-আনার তা হইবে না। দিকে দিকে বৃষ্টির বর্ষণ সেই দশা। স্বাভাবিক কারণেই কলিকতা অঞ্চলে একটা ভাষা জমিয়া উঠিয়াছে তােহা বাংলার সকল দেশের ভাষা। কলিকাতার একটা স্বকীয় অপভাষা আছে যাহাতে ‘গেনু করুনু প্রভৃতি ক্রিয়াপদ ব্যবহার হয় এবং ‘ভেয়ের বে’ (‘ভাইয়ের বিয়ে) “চেলের দাম’ (চালের দাম) প্রভৃতি