পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলা শব্দতত্ত্ব S)*s ইহা হইতে মনে হইতে পারে যে, এক-একটি সমগ্ৰ বস্তুকে বুঝাইতে টা' চিহ্নের প্রয়োগ এবং এক-একটি খণ্ডকে বুঝাইতে “খানা’ চিহ্নের প্রয়ােগ হইয়া থাকে। । গোড়ায় কী ছিল বলিতে পারি না, এখন কিন্তু এরূপ দেখা যায় না। আমরা বলি কাগজখানা, শ্লেটখানা। এই কাগজ ও শ্লেট সমগ্র পদার্থ হইলেও আসে যায় না। কিন্তু দেখা যাইতেছে যে-সকল সামগ্ৰী দীর্ঘ প্রস্থ বেধে সম্পূর্ণ, সাধারণত তাহাদের সম্বন্ধে “খান” ব্যবহার হয় না। যে জিনিসকে প্রস্থের প্রসারের দিক হইতেই দেখি, লম্বের বা বেধের দিক হইতে নয় প্রধানত তাঁহারই সম্বন্ধে “খান” ও “খানি'র যোগ। মােঠখানা, ক্ষেতখানা; কিন্তু পাহাড়খানা নদীখানা নয়। থালখানা, খােতাখানা, কিন্তু ঘটিখানা বাটিখানা নয়। লুচিখানা, কচুরিখানা, কিন্তু সন্দেশখানা মেঠাইখানা নয়। শালপাতাখানা, কলাপাতাখানা; কিন্তু আমখানা কঁঠালখানা এই যে নিয়মের উল্লেখ করা গেল। ইহা সর্বত্র খাটে না। যে জিনিস পাতলা নহে তাহার সম্বন্ধেও “খান” ব্যবহার হইয়া থাকে। যেমন খাটখানা, চৌকিখানা, ঘরখানা, নৌকাখানা। ইহাও দেখা গিয়াছে, এই “খান” চিহ্নের ব্যবহার সম্বন্ধে সকলের অভ্যাস সমান নহে! তবে ‘খানার প্রয়োগ সম্বন্ধে কয়েকটা সাধারণ নিয়ম বলা যায়। জীব সম্বন্ধে কোথাও ইহার ব্যবহার নাই ; গোরুখানা ভেড়াখানা হয় না। দেহ ও দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্বন্ধে ইহার ব্যবহারে বাধা নাই। দেহখানা, হাতখানা, পাখানা। বুকখানা সাত হাত হয়ে উঠল ; মায়ের কোলখানি ভরে আছে ; মাংসখানা ঝুলে পড়েছে; ঠোটখানি রাঙা ; ভুরুখানি বঁকা। অরূপ পদার্থ সম্বন্ধে ইহার ব্যবহার নাই। বাতােসখানা বলা চলে না ; আলোখানাও সেইরূপ ; কারণ, তাহার অবয়ব নাই। যত্নখানা, আদরখানা, ভয়খানা, রাগখানা হয় না। কিন্তু ব্যতিক্রম আছে ; যথা, ভাবখানা, স্বভাবখানা, ধরুনখানা চলনখানি। যে-সকল বস্তু অবয়ব গ্ৰহণ না করিয়া তরল বা বিচ্ছিন্নভাবে থাকে তাহদের সম্বন্ধে “খান” বসে না। যেমন, বালিখানা, ধুলোখানা, মাটিখানা, দুধখানা, জলখানা, তেলখানা হয় না। : ধুলা কাদা তেল জল প্রভৃতি শব্দের সহিত এক” শব্দটিকে বিশেষণরূপে যোগ করা যায় না। যেমন, একটা ধুলা বা একটা জল বলি না। কিন্তু অনেক’ শব্দটির সহিত এরূপ কোনো বাধা নাই। যেমন, অনেকটা জল বা অনেকখানি জল বলা চলে। বলা বাহুল্য এখানে 'অনেক’ শব্দ দ্বারা সংখ্যা বুঝাইতেছে না-পরিমাণ বুঝাইতেছে। . . . এখানে বিশেষরূপে লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, এরূপ স্থলে আমরা “খানি” ব্যবহার করি ; ‘খান’ ব্যবহার করি না। অনেকখানি দুধ’ বলি, অনেকখানা দুধ’ বলি না। এ স্থলে দেখা যাইতেছে, পরিমাণ ও সংখ্যা সম্বন্ধে খানি” ব্যবহার হয়, “খান” কেবলমাত্র সংখ্যা সম্বন্ধেই খাটে। ৷ বাংলায় হাসিখানি শব্দ প্রচলিত আছে। কিন্তু ইহা আদরের ভাষা। আদর করিয়া হাসিকে যেন স্বতন্ত্র একটি বস্তুর মতো করিয়া দেখা যাইতেছে। মনে পড়িতেছে। বৈষ্ণব সাহিত্যে এমন ভাবের কথা কোথায় দেখিয়াছি যে, তাহার মুখের কথাখিনির। যদি লােগ পাইতাম- এখানে আদর করিয়া মুখের কথাটিকে যেন মূর্তি দেওয়া হইতেছে। এইরূপ ভাবেই স্পর্শখানি' বলিয়া খানি ও খানা যেখানে বসে সেখানে ইচ্ছামতো সর্বত্রই টি ও টা বসিতে পারে---কিন্তু টি ও টা-র স্থলে সর্বত্র খানি ও খানার অধিকার নাই।