পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8良Q রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বাংলাকে বাংলা বলে স্বীকার করেও এ কথা মানতে হবে যে সংস্কৃতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। সংস্কৃত ভাষায় ভারতীয় চিত্তের যে আভিজাত্য, যে তপস্যা আছে বাংলা ভাষায় তাকে যদি গ্রহণ না করি। তবে আমাদের সাহিত্য ক্ষীণপ্রাণ ও ঐশ্বর্যভ্ৰষ্ট হবে। SS এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে য়ুরোপীয় বিদ্যার যোগে নতুন বাংলা সাহিত্য, এমন-কি, কিয়ৎ পরিমাণে ভাষাও তৈরি হয়ে উঠেছে, বর্তমান কালের ভাব ও মনন-ধারা বহন করে এই যোগ যেমন আমাদের উদবোধনের সহায় হয়েছে, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের নিরন্তর সম্বন্ধও আমাদের তেমনি সহায়। যুরোপীয় চিত্তের সঙ্গে আমাদের সাহিত্যের যদি বিচ্ছেদ ঘটে, তবে তাতে করে আমাদের যে দৈনা ঘটবে সে আমাদের পক্ষে শোচনীয়, তেমনি সংস্কৃতের ভিতর দিয়ে প্রাচীন ভারতীয় চিত্তের যোগপ্রবাহ যদি ক্ষীণ বা অবরুদ্ধ হয়, তবে তাতেও বাংলা ভাষার স্রোতস্বিনী বিশুদ্ধতা ও গভীরতা হারাবে। ভাবের দিকের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, শব্দের দিক থেকে বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কাছে নিরন্তর আনুকূল্যের অপেক্ষা না করে থাকতে পারে না। বাংলায় লিখতে গিয়ে আমাকে প্রতি পদে নতুন কথা উদভাবন করতে হয়েছে। তার কারণ বাংলা ভাষা একদিন শুদ্ধমাত্র ঘরের ভাষা ছিল। সেজন্য এর দৈন্য বা অভাব যথেষ্ট রয়ে গেছে ; সে দৈন্য পূরণের সুযোগ আমাদের দেশেই আছে। জাপানি ভাষার মধ্যে অনুরূপ একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। জাপানি ভাষায় তত্ত্বঘটিত শব্দরচনা সহজ নয়। জাপানির সঙ্গে সেজন্যে চীনে ভাষার যোগ রয়ে গেছে। যুদ্ধের দ্বারা সেদিনও জাপান চীনকে অসম্মান করেছে, অপমান করেছে। কিন্তু ভাষার মধ্যে সে চীনকে সম্মান করতে বাধ্য। তাই জাপানি অক্ষরের মধ্যে চৈনিক অক্ষর অপরিহার্য। ঘরের কথা জাপানি ভাষায় চলে হয়তো, কিন্তু চীনে ভাষা সঙ্গে না থাকলে বড়ো কোনো জ্ঞান বা উপলব্ধির প্রকাশ অসম্ভব হয়। অনুরূপ কারণেই বাংলাকে সংস্কৃত ভাষার দানসত্র ও অন্নসত্র থেকে দূরে নিয়ে এলে তাতে গুরুতর ক্ষতি ঘটবে। আমাকে যে উপাধিতে আপনারা ভূষিত করলেন, তার জন্যে আবার আপনাদের প্রতি আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। কিন্তু এও বলি যে, অযোগ্য পাত্রে যদি সম্মান অৰ্পিত হয়ে থাকে সে দায়িত্ব আপনাদের। আমার কিছুই গোপন নেই। সংস্কৃত ভাষায় আমার অধিকার সংকীর্ণ। তথাপি যখন আপনারা আমাকে এই পুরস্কার দিলেন এর জন্যে কাউকে যদি নিন্দাভাগী হতে হয় তো সে আপনাদের।” दार्टि · ७७४ ভাষার খেয়াল ভাষা যে সব সময়ে যোগ্যতম শব্দের বাছাই করে কিংবা যোগ্যতম শব্দকে বাঁচিয়ে রাখে তার প্রমাণ পাই নে। ভাষায় চলিত একটা শব্দ মনে পড়ছে “জিজ্ঞাসা করা”। এ রকম বিশেষ্য-জোড়া ওজনে ভারী ক্রিয়াপদে ভাষার অপটুত্ব জানায়। প্রশ্ন করা ব্যাপারাটা আপামর সাধারণের নিত্যব্যবহার্য অথচ ওটা প্রকাশ করবার কোনো সহজ ধাতুপদ বাংলায় দুর্লভ এ কথা মানতে সংকোচ লাগে। বিশেষ্য বা বিশেষণ রূপকে ক্রিয়ার রূপে বানিয়ে তোলা বাংলায় নেই যে তা নয়। তার উদাহরণ যথা— ঠ্যাঙানো, কিলোনো, ঘুযোনো, গুতেনো, চড়ানো, লাথানো, জুতেনে!! ১. সংস্কৃত কলেজ কর্তৃক “কবি সার্বভৌম” উপাধিন্দান ও অভিনন্দনের উত্তরে কথিত।