পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলা শব্দতত্ত্ব । 8 S এগুলো মারাত্মক শব্দ সন্দেহ নেই, এর থেকে দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে বাংলায় ‘আনো” প্রত্যয় সময়ে সময়ে এই পথে আপন কর্তব্য স্মরণ করে। অপেক্ষাকৃত নিরীহ শব্দও আছে, যেমন আগলি থেকে আগলানো ; ফল থেকে ফলানো, হাত থেকে হাতানো, চমক থেকে চমকানো। বিশেষণ শব্দ থেকে, যেমন উলটা থেকে উলটানো, খোড়া থেকে খোঁড়ানো, বাঁকা থেকে বঁকানো, রাঙা থেকে রাঙানো। - বিদ্যাপতির পদে আছে "সখি, কি পুছসি অনুভব মোয়’। যদি তার বদলে-“কি জিজ্ঞাসা করই অনুভব মোয়’ ব্যবহারটাই বাধ্যতামূলক’ হত কবি তা হলে ওর উল্লেখই বন্ধ করে দিতেন।” অথচ প্রশ্ন করা অর্থে খণ্ডধানো শব্দটা শুধু যে কবিতায় দেখি তা নয় অনেক জায়গায় প্রামের লোকের মুখেও ঐ কথার চল আছে। বাংলা ভাষার ইতিহাসে যারা প্রবীণ তঁদের আমি শুধাই, জিজ্ঞাসা করা শব্দটি বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে বা লোকসাহিত্যে তঁরা কোথাও পেয়েছেন। কিনা। ভাবপ্রকাশের কাজে শব্দের ব্যবহার সম্বন্ধে কাব্যের বোধশক্তি গদ্যের চেয়ে সূক্ষ্মতর এ কথা মানতে হবে। লক্ষ্যিয়া, সন্ধিয়া, বন্দিনু, স্পশিল, হৰ্ষিল শব্দগুলো বাংলা কবিতায় অসংকোচে চালানো হয়েছে। এ সম্বন্ধে এমন নালিশ চলবে না যে, ওগুলো কৃত্রিম, যেহেতু চলতি ভাষায় ওদের ব্যবহার নেই। আসল কথা, ওদের ব্যবহার থাকাই উচিত ছিল ; বাংলা কাব্যের মুখ দিয়ে বাংলা ভাষা। এই ত্রুটি কবুল করেছে। (‘কবলেছে প্রয়োগ বাংলায় চলে। কিন্তু অনভ্যস্ত কলমে বেধে গেল!)। ‘দর্শন লাগি ক্ষুধিল আমার আঁখি।” বা “তিয়াযিল মোর প্রাণ— কাব্যে শুনলে রসজ্ঞ পাঠক বাহবা দিতে পারে, কেননা, ক্ষুধাতৃষ্ণাবাচক ক্রিয়াপদ বাংলায় থাকা অত্যন্তই উচিত ছিল, তারই অভাব মোচনের সুখ পাওয়া গেল। কিন্তু গদ্য ব্যবহারে যদি বলি যতই বেলা যাচ্চে ততই ক্ষুধাচ্চি অথবা তেষ্টাচ্চি” তা হলে শ্রোতা কোনো অনিষ্ট যদি না করে অন্তত এটাকে প্রশংসনীয় বলবে না। বিশেষ্য-জোড়া ক্রিয়াপদের জোড় মিলিয়ে এক করার কাজে মাইকেল ছিলেন দুঃসাহসিক। কবির অধিকারকে তিনি প্রশস্ত রেখেছেন, ভাষার সংকীর্ণ দেউড়ির পাহারা তিনি কেয়ার করেন নি। এ নিয়ে তখনকার বাঙ্গ রসিকেরা বিস্তর হেসেছিল। কিন্তু ঠেলা মেরে দরজা। তিনি অনেকখানি ফাক ক’রে দিয়েছেন। ‘অপেক্ষা করিতেছে না বলে “আপেক্ষিছে’, ‘প্রকাশ করিলাম” না বলে প্রকাশিলাম' বা উদঘাটন করিলা'-র জায়গায় উদঘাটিল’ বলতে কোনো কবি আজ প্ৰমাদ গণে না। কিন্তু গদ্যটা যেহেতু চলতি কথার বাহন ওর ডিমক্রাটিক বেড়া অল্প একটু ফাক করাও কঠিন। 'ত্ৰাস’ শব্দটাকে ‘ত্ৰাসিল’ ক্রিয়ার রূপ দিতে কোনো কবির দ্বিধা নেই। কিন্তু ভয়’ শব্দটাকে “ভায়িল’ করতে ভয় পায় না। এমন কবি আজও দেখি নি। তার কারণ ত্ৰাস শব্দটা চলতি ভাষার সামগ্ৰী •ায়, এইজন্যে। ওর সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অসামাজিকতা ডিমক্রাসিও খাতির করে। কিন্তু ভয়” কথাটা সংস্কৃত হলেও প্রাকৃত বাংলা ওকে দখল করে বসেচে। এইজন্যে ভয় সম্বন্ধে যে প্রত্যয়টার ব্যবহার বাংলায় নেই তার দরজা বন্ধ। কোন এক সময়ে জিতিল’ হাঁকিল’ বঁকিল’ শব্দ চলে গেছে, ‘ভয়িল” চলে নি- এ ছাড়া আর-কোনো কৈফিয়ত নেই। ১ বাধ্যতামূলক' নামে যে একটা বর্বর শব্দ বাংলাভাষাকে অধিকার করতে উদ্যত, তার সম্বন্ধে কি সাবধান হওয়া উচিত হয় না ? কম্পলসরি এডুকেশনে বাধ্যতা বলে বালাই যদি কোথাও থাকে সে তার মূলে নয়। সে তাঁর পিঠের দিকে বা কাধের উপর, অর্থাৎ ঐ এডুকেশনটা বাধ্যতাগ্রন্ড বা বাধ্যতাঁচালিত। যদি বলতে হয়। পরীক্ষায় সংস্কৃত ভাষা কম্পিলসরি নয়, তা হলে কি বলা চলবে “পরীক্ষায় সংস্কৃত ভাষা বাধ্যতামূলক নয়।” "শ"ভাগাক্ৰমে 'আবশ্যিক” শব্দটা উক্ত অর্থে কোথাও কোথাও চলতে আরম্ভ করেছে।