পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 VV রবীন্দ্র-রচনাবলী ‘জাতি’ শব্দ এবং ‘নেশন’ শব্দ উভয়েরই মূল ধাতুগত অর্থ এক। জন্মগত ঐক্য নির্দেশ করিবার জন্য উভয় শব্দের উৎপত্তি। আমরা ব্ৰাহ্মণ প্রভৃতি বৰ্ণকে জন্মগত ঐক্যবশত জাতি বলি, আবার বাঙালি প্রভৃতি প্ৰজাবৰ্গকেও সেই কারণেই জাতি বলিয়া থাকি। জাতি শব্দের শেষোক্ত প্রয়োগের স্থলে ইংরাজিতে ‘নেশন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যথা, বাঙালি জাতি = বেঙ্গলি নেশন। এরূপ স্থলে ন্যাশনাল’ শব্দের প্রতিশব্দরূপে জাতীয়’ শব্দ ব্যবহার করাতে বিশেষ দোয্যের কারণ দেখা যায় না। আমরাও তাঁহাই করিয়াছি। কিন্তু সম্পাদক মহাশয় অকস্মাৎ অকারণে অনুমান করিয়া লইয়াছেন যে আমরা জাতীয় সাহিত্য’ শব্দে ‘ভর্ন্যাকুলের লিটারেচর’ শব্দের অপূর্ব তৰ্জমা করিয়ছি! বিনীতভাবে জনাইতেছি আমরা এমন কাজ করি নাই। সাহিত্য যে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আমোদ বা শিক্ষাসাধক নহে, তাহা যে সমস্ত জাতির ‘জাতীয় বন্ধন দৃঢ়তর করে, বাংলা সাহিত্য, যে, বাঙালি জাতির ভূত ভবিষ্যৎকে এক সজীব সচেতন নাড়ি-বন্ধনে বাঁধিয়ে দিয়া তাহাকে বৃহত্তর এবং ঘনিষ্ঠতর করিয়া তুলিবে- আমাদের প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গের বিশেষরূপ অবতারণা ছিল বলিয়া, আমরা বাংলা সাহিত্যকে, ব্যক্তিগত রসসম্ভোগের হিসাবে নহে, পরস্তু সাহিত্য আখ্যা দিয়াছিলাম। সভাস্থলে বক্তৃতা পাঠ করিতে হইলে শ্রোতৃসাধারণের দ্রুত অবগতির জন্য বিষয়টিকে কিঞ্চিৎ বিস্তারিত করিয়া বলা আবশ্যক হইয়া পড়ে—আমরাও বক্তৃতার বিষয় যথোচিত বিস্তুত করিয়া বলিয়া কেবল সম্পাদক মহাশয়ের নিন্দাভাজন হইলাম। কিন্তু তথাপিও তিনি আমাদের বক্তব্য-বিষয়টিকে সম্যক গ্রহণ করিতে পারিলেন না ইহাতে আমাদের দ্বিগুণ দুঃখ রহিয়া গেল। TR లింQ নামের পদবী । শ্ৰীযুক্ত সত্যভূষণ সেন বাঙালি মেয়ের পদবী প্রসঙ্গে আমাকে যে চিঠিখানি লিখেছেন ১ তার উত্তরে আমার যা বলবার আছে বলে নিই, যদিও ফলের আশা রাখি নে। ] বাংলা দেশে সামাজিক ব্যবহারে পরস্পরের সম্মানের তারতম্য জাতের সঙ্গে বাঁধা ছিল। দেখাসাক্ষাৎ হলে জাতের খবরটা আগে না জানতে পারলে অভিবাদন অভ্যর্থনা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থাকত। পাকা পরিচয় পেলে তবে একপক্ষ পায়ের ধুলো দেবে, আর-একপক্ষ নেবে, আর বাকি যারা তারা পরস্পরকে নমস্কার করবে কিংবা কিছুই করবে না। এই ছিল বিধান। সামাজিক ব্যবহারের বাইরে লৌকিক ব্যবহারে যে-একটা সাধারণ শিষ্টতার নিয়ম প্রায় সকল দেশেই আছে—আমাদের দেশে অনতিকলিপূর্বেও তা ছিল না। যেখানে স্বার্থের গরজ ছিল এমন কোনাে বেলা নতিস্বীকার করে তুষ্ট করা প্রার্থীর পক্ষে অত্যাবশ্যক। কিন্তু জাতে-বাঁধা রীতি ছাড়া আর কোনো রীতি না থাকতে কিছুদিন পূর্বে এই রকম সংকটের স্থলে সম্মানের একটা কৃপণ প্রথা। দায়ে পড়ে উদ্ভাবিত হয়েছিল। সে হচ্ছে ড্রান হাতের মুঠো বেঁধে দ্রুতবেগে নিজের নাসাগ্র ১ দ্রষ্টব্য, বিচিত্রা', শ্রাবণ ১৩৩৮