পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীতচিন্তা (¢(ሱ “ነ যদুভট্টর কাছেও তিনি শিক্ষা পেয়েছিলেন। যাঁদের কাছে তঁর পরিচয় ছিল তঁরা সকলেই জানেন রাধিকা গোস্বামীর কেবল যে গানের সংগ্রহ ও রাগরাগিণীর রূপজ্ঞোন ছিল তা নয়, তিনি গানের মধ্যে বিশেষ একটি রসসঞ্চার করতে পারতেন। সেটা ছিল ওস্তাদের চেয়ে কিছু বেশি। সেটা যদি নাও থাকত। তবু তাকে আমরা ওস্তাদ বলেই গণ্য করতুম, এবং ওস্তাদের কাছ থেকে যেটা আদায় করবার তা আমরা আদায় করতুম- আমরা আদায় করেও ছিলুম। সে-সব কথা সকলের জানা তঁর মৃত্যুর পরেও ওস্তাদের খোঁজ করবার দরকার ঘটেছিল। শান্তিনিকেতনে হিন্দুস্থানী গান শিক্ষা দেবার প্রয়োজন বোধ করি। নিজেও চেষ্টা করেছি, বন্ধুবান্ধবদেরকেও অনুরোধ জানিয়েছি, স্বয়ং দিলীপকুমারকেও এ সম্বন্ধে আমার অভাব জ্ঞাপন করেছি। তখনি আবিষ্কার করা গেল বাংলা দেশে একমাত্র হিন্দুস্থানী গানের ওস্তাদ আছেন শ্ৰীযুক্ত গোপেশ্বর। আর যাঁরা আছেন তঁরা কেউ তার সমকক্ষ নন, এবং অনেকে তঁরই আত্মীয়। আমি তাকেও শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা কাজের জন্যে পেতে ইচ্ছা করেছিলুম। কিন্তু কলকাতায় তঁর এত কাজ যে তঁাকে কলকাতার বাইরে পাওয়া সম্ভব হয় নি। দিলীপকুমার তীর চেয়ে যোগ্যতর কোনো ওস্তাদের কথা আমাকে জানাতে পারেন নি। আজকের দিনে কলকাতায় যেখানেই সংগীতশিক্ষার প্রয়োজন হয়েছে সেখানেই তাকে ডাক পড়েছে। আর যাই হােক, আজকের দিনে সাধারণের মতে তিনিই বড়ো ওস্তাদ বলে স্বীকৃত। যাঁরা সংগীতব্যবসায়ী নন, বাংলা দেশে তাদের মধ্যে গোপেশ্বরবাবুর চেয়ে বড়ো ওস্তাদ কেউ আছেন কি না সে কথা বলা কঠিন। যাঁরা সংগীতব্যবসায়ী তারা শিশুকাল থেকেই একান্তভাবে গান-শিক্ষায় প্রবৃত্ত, অনেক স্থলে তঁদের বংশের মধ্যে গান-চৰ্চার ধারা প্রবহমান। অতএব গানের সংগ্রহ ও সাধনা সম্বন্ধে তাদের উপর নির্ভর করা চলে। এক সময়ে আমি বহুল পরিমাণেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার চর্চা করেছিলুম। দৈবাৎ আমার চিকিৎসায় যারা ফল পেয়েছিলেন তঁরা ব্যবসায়ী চিকিৎসককে ছেড়ে আমার কাছেই আসতেন। তার থেকে আমার পক্ষপাতীর দল যদি বিচার করতেন। আমি সত্যিই বড়ো ডাক্তার, তবে তঁদের সেই বিশ্বাসের জোরে আমার ডাক্তারি বিদ্যার প্রমাণ হত না। অন্যান্য শিক্ষা বা কাজকর্মের ফঁাকে ফঁাকে যাঁরা কোনো-একটি বিদ্যার চর্চা করেন, সাধারণত তাদের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। এমন দলের যাঁরা একান্তভাবেই সেই বিদ্যার চৰ্চা করেছেন। অব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিভা-সম্পন্ন লোক থাকতে পারেন, কিন্তু পূর্বেই বলেছি হিন্দুস্থানী সংগীতের মতো প্রাচীন অলংকারশাস্ত্রের দ্বারা প্রায় আচলভাবে নিয়মিত বিদ্যায় কেবল প্রতিভা-দ্বারা ওস্তাদি লাভ করা যায় না, বহুল শিক্ষা ও চর্চার দ্বারাই করা যায়। আর-একটি বিষয় নিয়ে তর্ক হচ্ছে- গোপেশ্বরবাবুর গানের স্টাইলটা বিষ্ণুপুরী বলে কেউ কেউ তাঁর ওস্তাদিতে কলঙ্ক আরোপ করে থাকেন। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্ৰে দেখা যায় যে, প্রদেশভেদে সাহিত্যের স্বাভাবিক রীতিভেদ স্বীকার করা হয়েছে। বৈদভী রীতি, গৌড়ীয় রীতি প্রভৃতি রীতির বিশিষ্টতা তিরস্কৃত হয় নি। ভারতীয় স্থাপত্যে দেখা যায় দক্ষিণভারতের স্থাপত্যের সঙ্গে উড়িষ্যার ও উত্তরভারতের অনেক পার্থক্য। মাদুরার মন্দির রচনায় স্থাপত্য পদে পদে যে তান লাগিয়েছে তার অংশে অংশে অলংকার-বৈচিত্রের ষে অতি বাহুল্য তা কারো কারো ভালো লাগে না। তার সঙ্গে সেকেন্দ্রার স্থাপত্যের তনবিহীনতা ও অলংকারবিরলতার তুলনা করলে সেকেন্দ্ৰাকেই কারো কারো রুচিতে ভালো ঠেকে। তবুও ভারতীয় স্থাপত্যে দক্ষিণী রীতিকে অস্বীকার করা চলে না। তেমনিই হিন্দুস্থানী গান বাংলা দেশে যদি কোনো বিশেষ রীতি অবলম্বন