পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীতচিন্তা (?○○ তার স্বাভাবিক ভগবদভক্তিতে নিয়ত প্রকাশ পেত এবং এই সংগীতের প্রভাব সাধবী স্ত্রীর সমস্ত আমার বিশ্বাস যে, সংগীত কেবল চিত্তবিনোদনের উপকরণ নয় ; তা আমাদের মনে সুর বেঁধে দেয়, জীবনকে একটি অভাবনীয় সৌন্দর্য দান করে। আমি তাই মনে করি যে, এই সংগীতসংঘের প্রতিষ্ঠা প্ৰতিভার জীবনের শ্রেষ্ঠ দান। তঁর আমরণকালের সাধনাকে তিনি এই সংঘে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। এখানে যে সংগীতের উৎস উৎসারিত হবে তা বাংলা দেশের নানা গৃহে প্রবাহিত হয়ে আমাদের দেশের প্রাণে মধু সঞ্চার করবে। এমনি করে এই গানের প্রবাহই তঁর জীবনের স্মৃতিকে বহন করতে থাকবে। এর চেয়ে তঁর স্মৃতিরক্ষার শ্রেষ্ঠতর উপায় হতে পারে না। তিনি দেশের হৃদয়ের মধ্যে তঁর জীবনের এই বাণীকে স্বয়ং স্থাপিত করেছেন। যাঁরা আজ সংগীত ও বাদ্য দিয়ে আমাদের আনন্দ দান করলেন, তঁদের আমি আশীৰ্বাদ করছি। সংগীতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বীণাপাণির পদ্মবনে তঁরা মধু আহরণ করতে এসেছেনতঁাদের সাধনা সার্থক হোক, মাধুর্যের অমৃত্যুরসের দ্বারা তারা দেশের চিত্তে শক্তি সঞ্চারিত করুন। অনেকের ধারণা আছে যে, বুঝি লড়াই করে দ্বন্দ্ৰসংঘর্যের মধ্য দিয়েই শক্তি প্রকাশিত হয়। তারা এ কথা স্বীকার করে না যে, সৌন্দর্য মানুষের বীর্যের প্রধান সহায়। বসন্তকালে গাছপালার যে নবকিশলয়ের উদগম হয় তা যেমন তার অনাবশ্যক বিলাসিত নয়, বাস্তবিক পক্ষে সে যেমন তার বড়ো সৃষ্টির একটি প্রক্রিয়া, তেমনি বড়ো বড়ো জাতির জীবনে যে রসসৌন্দর্যের বিস্তার হয়েছে তা তাদের পরিপুষ্টিরই উপকরণ জুগিয়েছে। এই-সকল রসই জাতির জীবনকে নিত্য নবীন করে রাখে, তাকে জরার আক্রমণ থেকে বাঁচায়, অমরাবতীর সঙ্গে মর্ত্যলোকের যোগ স্থাপন করে, এই রসসৌন্দর্যই মানবচিত্তে আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় বিকশিত হয়। পিপাসার জল আহরণ ও অন্ন বিতরণের ভার নারীদের উপরেই। তেমনি আমাদের মনের মধ্যে সংগীতের সে রসপিপাসা আছে তাও পরিতৃপ্ত করবার ভার যদি নারীরাই গ্রহণ করেন তা হলেই সেটা শোভন হয়। জীবের জীবনের ভার মেয়েদের উপর। কিন্তু, কেবল দেহেরই নয়, মনেরও জীবন আছে ; এই সংগীত হচ্ছে তারই তৃষ্ণার একটি পানীয়- এই পানীয়ের দ্বারা মনের প্রাণশক্তি সতেজ হয়ে ওঠে। জীবন নীরস হলে সঙ্গে সঙ্গে তা নিবীৰ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু, শুষ্কতার কঠোরতাই যে বীর্য এমন কথা আমাদের দেশে প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। অবশ্য, বাহিরে বীর্যের যে প্রকাশ সেই প্রকাশের মধ্যে একটা কঠিন দিক আছে, কিন্তু অন্তরের যে পূর্ণতা সেই কাঠিন্যকে রক্ষা করে সেই পূর্ণতার পরিপুষ্টি কোথা থেকে? এ হচ্ছে আনন্দরস থেকে। সেইটো চােখে ধরা পড়ে না বলে তাকে আমরা অগ্রাহ্য করি, অবজ্ঞা করি, তাকে বিলাসের অঙ্গ বলে কল্পনা করি। গাছের গুড়ির কাষ্ঠ অংশটাকে দিয়েই তো গাছের শক্তি ও সম্পদের হিসাব করলে চলবে না। সেটাকে খুব স্থূলরক্ষপে স্পষ্ট করে দেখা যায় সন্দেহ নেই; আর গৃঢ়ভাবে তার অণুতে অণুতে যে রস সঞ্চারিত হয়, যে রসের সঞ্চারণই হচ্ছে গাছের যথার্থ প্রাণশক্তি, সেটা স্কুল নয়, কঠিন নয়, বাহিরে সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ নয় বলেই তাকে খর্ব করা সত্যদৃষ্টির অভাব-বশতই ঘটে। গুড়ির সত্যটা রসের সত্যের চেয়ে বড়ো নয়, গুড়ির সত্য রসের সত্যের উপরেই নির্ভর করে- এই কথাটা আমাদের মনে রাখতে হবে। " . . . . . যখন দেখতে পাব যে আমাদের দেশে সংগীত ও সাহিত্যের ধারা বন্ধ হয়েছে, তখন বুঝব। দেশে প্রাণশক্তির স্রোতও অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। সেই প্ৰাণশক্তিকে নানা শাখা-প্ৰশাখায় পূর্ণভাবে বহমান করে রাখবার জন্যেই, বিশ্বের গভীর কেন্দ্র থেকে যে অমৃতরসধারা উৎসারিত হচ্ছে তাকে