পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

«፩ ዓ S রবীন্দ্র-রচনাবলী কবিবর বললেন, “তোমার লেখার সঙ্গে মূলত আমি একমত। যারা রসরূপের লবণ্যে মজে জগতে তাদের সংখ্যা অল্প, যারা বাহাদুরিতে ভোলে তাদের সংখ্যাই বেশি। এইজন্য অধিকাংশ ওস্তাদই কসরত দেখিয়ে দিগবিজয় করে বেড়ায়। ছেলেবেলায় আমি একজন বাঙালি গুণীকে দেখেছিলাম, গান যার অন্তরের সিংহাসনে রাজমর্যাদায় ছিল- কাষ্ঠের দেউড়িতে ভোজপুরী দরোয়ানের মতো তাল-ঠোকাঠুকি করত না ; তঁর নাম তোমরা শুনেছ নিশ্চয়ই। তিনি বিখ্যাত যদুভট্ট, যাঁর কাছে রাধিকাবাবু কিছু শিখেছিলেন।” আমি বললাম, কিন্তু আপনার কি তীর গান মনে আছে? খুব ছেলেবেলায় আমাদের সংগীত সম্বন্ধে খুব অন্তর দৃষ্টি থাকে না ; কাজেই আমার বোধ হয় সে সময়ে উচ্চসংগীতে আমাদের হৃদয় কেমন সাড়া দেয় সেটাও ভালো স্মরণ থাকার কথা নয়।” কবিবর বললেন, কিন্তু আমার স্মৃতিতে এখনো সে সংগীতের রেশ লুপ্ত হয় নি। যদুভট্টর জীবনের একটি ঘটনা বলি শোনো। ত্রিপুরার বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য তঁর গানের বড়ো অনুরাগী ছিলেন। একবার তাঁর সভায় অভ্যাগত একজন হিন্দুস্থানী ওস্তাদ নটনারায়ণ রাগে একটি ছোটাে গান গেয়ে “যদুভট্টর সে রাগটি জানা ছিল না। কিন্তু তিনি পরদিনেই নটনারায়ণ শোনাবেন বলে প্রতিশ্রুত হলেন। ওস্তাদজী গাইলেন। যদুভট্টর কান এমনি তৈরি ছিল যে তিনি সেই দিনই রাতে বাড়ি গিয়ে চোতালে নটনারায়ণ রাগে একটি গান বাধলেন ও পরদিন সভায় এসে সকলকে শুনিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। তঁর রচিত সেই সুরে জ্যোতিদাদা একটি বাংলা গান রচনা করেছিলেন।” বলৈ কবিবর গুন গুন করে সে সুরটি একটু গেয়ে শোনালেন। আমি বললাম, এ রকম গায়ক এক-একজন করে যাচ্ছেন তাতে দুঃখ করা এক রকম বৃথা, কারণ গায়কও সংগীতের খাতিরে কিছু অমর হতে পারেন না। তবে আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে এই যে, আমাদের দেশে সংগীতরাজ্যে একজন গুণী গেলে তঁর স্থান পূর্ণ করবার লোক আর মেলে না। আমাদের দেশে গায়কদের মধ্যে যথার্থ শিল্পী ক্ৰমেই যে কী রকম বিরল হয়ে উঠছে তা জানেন এক যথার্থ সংগীতানুরাগী। যুরোপে এ রকমটা হয় না। সেখানে এক গায়ক যায় বটে, কিন্তু তার স্থানে অন্য গায়ক জন্মায়।” কবিবর বললেন, “তা সত্য।’ বলে একটু চুপ করে বললেন, “আজ তোমার সঙ্গে একটা আলাপ করতে চাই।” আমি সাগ্রহে বললাম, বলুন।' কবিবর বললেন, ‘অনেক সময়ে আমরা পরস্পরের মধ্যে যে মতভেদের কল্পনা করি, আলোচনা করতে গিয়ে দেখা যায়। তার অনেকখানিই ফাঁকি। বাংলা ও হিন্দুস্থানী গান নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার মতভেদ যদি বা থাকে তা হলে অন্তত তার সীমাটি স্পষ্ট করে নির্দিষ্ট হওয়া ভালো। নইলে সত্যের চেয়ে ছায়াটা বড়ো হয়ে অমিলটা প্ৰকাণ্ড দেখতে হয়। গোড়াতেই একটা কথা জোর করে বলে রাখি, ছেলেবেলা থেকে ভালো হিন্দুস্থানী গান শুনে আসছি বলে তার মহত্ত্ব ও মাধুর্য সমস্ত মন দিয়েই স্বীকার করি। ভালো হিন্দুস্থানী গানে আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করে। আমি বললাম, “এ কথাটা আমার ভারি ভালো লাগল। আর, আপনার মতন গুণগ্রাহী শিল্পীমানের কাছে আমি তো এইই আশা করেছিলাম। আপনার জীবনস্মৃতিতে হিন্দুস্থানী সংগীত সম্বন্ধে একটা যথার্থ অন্তর দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে অনেকের আপনার সহজ হালকা সুরের গান শুনে উলটাে ধারণা জন্মে থাকে যে, ওস্তাদি সংগীতের আপনি বিরোধী।”