পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(brО রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী একটা কথা জিজ্ঞাসা করি যে, বাংলা গানে হিন্দুস্থানী সংগীতের মতন অবাধ তনালাপের স্বাধীনতা দিলে তার বিশেষত্ব নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। এ কথা তুমি মােন কি না ?” আমি বললাম, মানি- যদি বাংলা গানে হুবহু হিন্দুস্থানী গানের তানালাপের পদ্ধতি নকল করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমি এ কথা ইতিপূর্বে লিখেছি যে, বাংলা গানে, বিশেষত কবিত্বময় ও ভাবময় গানে, তানের একটু সংযম করতেই হয়। সেইজন্য বাংলা গানে হিন্দুস্থানী সংগীতের অপূর্ব রস পুরোপুরি আমদানি করা চলে না। কিন্তু, তবু অনেকখানি চলে এ কথা আপনাকে মানতে হবে- বিশেষত সত্যকার শিল্পীর হাতে। কারণ, সত্যকার শিল্পী একটা সহজ সৌষ্ঠবজ্ঞান (sense of proportion) s 33r নিয়ে জন্মান এ কথা বোধ হয়। সত্য। আপনি যদি বিখ্যাত রসিক রায়বাহাদুর সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের মুখে আপনারই গান শুনতেন তা হলে বুঝতেন আমি কেন আপনার কাছ থেকে এ স্বাধীনতা চাইছি! অবশ্য, এক শ্রেণীর বাংলা গান আছে যা নিতান্তই সহজ সুরে রচিত ও সহজ সুরেই গোয়। সেগুলির সঙ্গে আমার বিবাদ নেই এবং সেগুলির সম্বন্ধে আমি এ স্বাধীনতা চাইছি না। আমি কেবল বলি এই কথা যে, আর-এক শ্রেণীর বাংলা গান কেন সৃষ্টি করা অসম্ভব হবেই হবে যার মধ্যে হিন্দুস্থানী সংগীতের, সম্পূর্ণ না হােক, অনেকখানি সৌন্দর্যের আমদানি করা চলবে? আমার সম্প্রতি অতুলপ্রসাদ সেনের কতকগুলি গান শুনে আরো বেশি করে মনে হয়েছে যে, এটা শুধু সম্ভব তাই নয়, এটা হবেই। আমি আরো একটু বেশি। বলতে চাই যে, এ দিকে বাংলা গানের বিকাশ অনেকটা ইতিমধ্যেই হয়েছে যার হয়তে আপনি সম্পূর্ণ খবর রাখেন না। এবং আমরা হিন্দুস্থানী সংগীতকে নিয়ে একটু উদারভাবে চেষ্টা করলে এ বিকাশ পরে আরো সমৃদ্ধতির হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই আমার মোট কথাটি এই যে, ংলা গান বাংলা বলেই তাতে তান দেওয়া চলবে না। এ কথা আমার সংগত মনে হয় না।” উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, “আমি তো কখনো এ কথা বলি নি যে, কোনো বাংলা গানেই তান দেওয়া চলে না। অনেক বাংলা গান আছে যা হিন্দুস্থানী কায়দাতেই তৈরি, তানের অলংকারের জন্য তার দাবি আছে। আমি এ রকম শ্রেণীর গান অনেক রচনা করেছি। সেগুলিকে আমি নিজের মনে কত সময়ে তান দিয়ে গাই।” বলে কবিবর স্বরচিত একটি ভৈরবী তান দিয়ে গাইলেন। তার পর তিনি বললেন, “হিন্দুস্থানী গানের সুরকে তো আমরা ছাড়িয়ে যেতে পারিই না! এতে যে দোষের কিছুই নেই এ কথাও তো আমি সাহিত্যের উপমা দিয়ে বললাম। কাজে কাজেই হিন্দুস্থানী গান ভালো করে শিখলে তার প্রভাবে যে বাংলা সংগীতে আরো নূতন সৌন্দৰ্য আসবে এটাই তো আশা করা স্বাভাবিক। তাই তোমরা এ চেষ্টা যদি কর তবে তোমাদের উদ্যোগে আমার অনুমোদন আছে। এ কথা নিশ্চয় জেনো। কেবল আমি তোমাকে বাংলার বিশেষত্ব সম্বন্ধে যে-কয়টি কথা বললাম। সে কথা-কটি মনে রেখো। বাংলার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে কেমন করে নূতন সৌন্দর্য বাংলা সংগীতে ফুটানো যেতে পারে এটা একটা সমস্যা। তবে চেষ্টা করলে এ সমস্যার সমাধানও না মিলেই পারে না। এ কথা স্মরণ রেখে যদি তুমি হিন্দুস্থানী সংগীত assimilate ক’রে বাংলার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য সাধন করতে পাের, তা হলে তুমি সাগরের মতনই সুরের সুরধুনী বইয়ে দিতে পারবে- নইলে সুরের জলপ্লাবনই হবে, কিন্তু তাতে তুষিতের তৃষ্ণা মিটবে না।” আমি বললাম, আপনার সঙ্গে তো দেখছি। এখন আমার কোনোই মতভেদ নেই।” কবিবর তার স্বভাবসিদ্ধ স্নিগ্ধ হাঁসি হাসলেন।. Հ. :