পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ brぐり রবীন্দ্র-রচনাবলী কবি বললেন, “ঐ ‘একান্ত” বিশেষণ পদের বাটখারাটা যখনি বেমালুম তুমি দাঁড়িপাল্লায় কেবল এক দিকেই চাপালে তখনি তোমার এক-বোকা বিচারের চেহারাটা ধরা পড়ল। সুরের সারল্য একান্ত হলেও যত বড়ো দোষ, সুরের বাহুল্য একান্ত হলেও দোষটা তত বড়োই। "একান্ত’ বিশেষণের যোগে যে কথাটা বলছি ভাষান্তরে সেটা দাঁড়ায় এই যে, সুরের দৃষণীয় সরলতা দোষের— যেন সুরের দূষণীয় বাহুল্য দোষের নয়! অর্থাৎ, বাহুলোর দিকে দোষটা তোমার সহ্য হয়, সারল্যের দিকের দোষটা তোমার কাছে অসহ্য। তোমার মতে ; অধিকন্তু দোষায়। সর্বমত্যন্তং গহিত্যুং- এটাতে তোমার মন সায় দেয় না। “কিন্তু, পরস্পরের ব্যক্তিগত মেজাজ নিয়ে তর্ক করে কী হবে ? জবার মালা মাথায় জড়িয়ে শাক্ত যদি সরস্বতীর শ্বেতপদ্মের দিকে কটাক্ষ করে বলে “তুমি নেহাত সাদা যাকে বলে রিক্ত’ তা হলে সরস্বতীর চেলাও জবাকে বলবে, “তুমি নেহাত রাঙা যাকে বলে উগ্র !" এতে কেবল কথার ঝাজ বেড়ে ওঠে, তার মীমাংসা হয় না। আমি তাই তর্কের দিকে না গিয়ে সারল্য সম্বন্ধে আমার মনোভাবটা বলি । ‘অনেক দিন আছি। শান্তিনিকেতনে। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যে অরণ্য গিরি নদীর আয়োজন নেই। যদি থাকত সেটাকে উপযুক্তভাবে ভোগ করা কঠিন হত না। কারণ সৌন্দর্যসম্পদ ছাড়াও বহুবৈচিত্রের একটা জোর আছে, সেটা পরিমাণগত । নানা দিক থেকে সে আমাদের চোখকে বেড়াজালে ঘেরে, কোথাও ফাক রাখে না। ‘এখানকার দৃশ্যে আয়োজনের বিরলতায় আমাকে বিশেষ আনন্দ দেয়। সকাল বিকাল মধ্যাহ্ন এই অবারিত আকাশে আলোছায়ার তুলিতে কত রকমের সূক্ষ্ম রঙের মরীচিকা একে যায়, আমার মিতভোগী অক্লান্ত চোখের ভিতর দিয়ে আমার মন তার সমস্তটার স্বাদ পুরোপুরি আদায় করে : এখানকার বাধাহীন আকাশসভায় বর্ষা বসন্ত শরৎ তাদের ঋতুবীণায় যে গভীর মীড়গুলি দিতে থাকে তার সমস্ত সূক্ষ্ম শ্রুতি কানে এসে পৌছয়। এখানে রিক্ততা আছে ব’লেই মনের বোধশক্তি অলস হয়ে পড়ে না, অথবা বাইরের চাপে অভিভূত হয় না। ‘একটা উপমা দিই। একজন রূপারসিকের কাছে গেছে একটি সুন্দরী। তার পায়ে চিত্ৰ-বিচিত্রকরা একজোড়া রঙিন মোজা। রূপদক্ষকে পায়ের দিকে তাকাতে দেখে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলে মোজার কোন অংশে তীর নজর পড়েছে। গুণী দেখিয়ে দিলেন মোজার যে অংশ ছেড়া। রূপসীর পা-দুটি ঐ যে মোজার ফুলকাটা কারুকাজে তানের পর তান লাগিয়েছে নিশ্চয়ই আমাদের হিন্দুস্থানী মহারাজ তার প্রতি লক্ষ করেই বলতেন ‘বাহবা, বলতেন ‘সাবাস'। কিন্তু গুণী বলেন বিধাতার কিংবা মানুষের রসরচনায় বাণী যথেষ্টের চেয়ে একটুমাত্র বেশি হলেই তাকে মৰ্মে মারা হয়। সুন্দরীর পা-দুখানিই যথেষ্ট, যার দেখবার শক্তি আছে দেখে তার তৃপ্তির শেষ হয় না। যার দেখবার শক্তি অসাড়, ফুলকাটা মোজার প্রগলাভতায় মুগ্ধ হয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে। ‘অধিকাংশ সময়েই উপাদানের বিরলতা ব্যঞ্জনার গভীরতাকে অভ্যর্থনা করে আনে। সেই বিরলতাকে কেউ-বা বলে শূন্য কেউ পূর্ণ ব'লে। অনুভব করে। পূর্বে তোমাকে একটা উপম' দিয়েছি, এরার একটা দৃষ্টান্ত দিই। : “বাংলা গীতাঞ্জলির কবিতা ইংরেজিতে আপন মনেই তর্জমা করেছিলাম। শরীর অসুস্থ ছিল, আর-কিছু করবার ছিল না। কোনোদিন এগুলি ছাপা হবে এমন স্পর্ধার কথা স্বপ্নেও ভাবি নি। তার্থ কারণ, প্রকাশযোগ্য ইংরেজি লেখবার শক্তি আমার নেই- এই ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল ছিল ।