পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

と8ミ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বাংলা দেশে যন্ত্রসংগীত নিজের কোনো বিশেষত্ব উদ্ভাবন করে নি। সেতার এসরাজ সরদ রবার প্রভৃতি যন্ত্র হিন্দুস্থানের বানানো, তার চর্চাও হিন্দুস্থানেই প্রসিদ্ধ। ‘ওরে রে লক্ষ্মণ, একি কুলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ’ প্রভৃতি পাঁচালি-প্রচলিত গানে অর্থ স্বল্পই, অনুপ্রাসের ফেনিলতাই বেশি, অতএব প্রায় সে তোলেনার কাছ ঘেষে গেছে, কিন্তু তবু তোম--তানােনানার মতো আমন, নিঃসংকোচে নিরর্থক নয়। পরজ রাগিণীতে একটা হিন্দি গান জানতুম, তার বাংলা তৰ্জমা এই— কালো কালো কম্বল, গুরুজি, আমাকে কিনে দে, রাম-জ্ঞাপনের মালা এনে দে আর জল পান। করবার তুম্বী। ঐ ফর্দে উদ্ধৃত ফরমাশী জিনিসগুলিতে যে সুগভীর বৈরাগ্যের ব্যঞ্জনা আছে পরািজ রাগিণীই তা ব্যক্তি করবার ভার নিয়েছে। ভাযাকে দিয়েছে সম্পূর্ণ ছুটি । আমি বাঙালি, আমার স্কন্ধে নিতান্তই যদি বৈরাগ্য ভর করত, তবে লিখাতুম।-- গুরু, আমায় মুক্তিধনের দেখাও দিশা। কম্বল মোর সম্বল হোক দিবানিশা । সম্পদ হোক জাপের মালা নামমণির-দীপ্তি-জ্বালা, তুম্বীতে পান করব যে জল মিটবে তাহে বিষয়তৃষা। কিন্তু এ গানে পরজ তার ডানা মেলতে বাধা পেত। পরজ হত সাহিত্যের খাঁচার পাখি। হিন্দুস্থানী? গাইয়ে তানপুরা নিয়ে বসলেন, বললেন- আমার এই চুনরিয়া লাল রঙ করে দে, যেমন তোর ঐ পাগড়ি তেমনি আমার এই চুনরিয়া লাল রঙ করে দে! বাস, আর কিছু নয়, এই কাটি কথার উপর কানাড়া অপ্রতিহত প্রভাবে রাজত্ব বিস্তার করলে। বাঙালি গাইলে— ভালোবাসিবে ব’লে ভালোবাসি নে । আমার যে ভালোবাসা তোমা বই আর জানি নে। হেরিলে ও মুখশশী আনন্দসাগরে ভাসি, তাই তোমারে দেখতে আসি।-- দেখা দিতে আসি নে । যা-কিছু বলবার, আগেভাগে তা ভাষা দিয়েই বলে দিলে, ভৈরবী রাগিণীর হাতে খুব বেশি কাজ दर्देन नीं । বাঙালির এই স্বভাব নিয়েই তাকে গান গাইতে হবে । বললে চলবে না। রাতের বেলাকার চক্ৰবাকদম্পতির মতো ভাষা পড়ে থাকবে নদীর পূর্ব পারে আর গান থাকবে পশ্চিম পারে, "and never the twain shall meet' } বাঙালির কীর্তনগানে সাহিত্যে সংগীতে মিলে এক অপূর্ব সৃষ্টি হয়েছিল— তাকে প্রিমিটিভ এবং ফোক মূজিক বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। উচ্চ অঙ্গের কীর্তন গানের আঙ্গিক খুব জটিল ও বিচিত্র, তার তাল ব্যাপক ও দুরূহ, তার পরিসর হিন্দুস্থানী গানের চেয়ে বড়ো। তার মধ্যে যে বহুশাখায়িত নাট্যরস আছে তা হিন্দুস্থানী গানে নেই। বাংলায় নুতন যুগের গানের সৃষ্টি হতে থাকবে ভাষায় সুরে মিলিয়ে। এই সুরকে খর্ব করলে চলবে না। তার গৌরব কথার গৌরবের চেয়ে হীন হবে না। সংসারে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকারে দাম্পত্যের যে পরিপূর্ণ উৎকর্ষ ঘটে, বাংলা সংগীতে তাই হওয়া চাই। এই মিলনসাধনে: ধ্রুবপদ্ধতির হিন্দুস্থানী সংগীতের সহায়তা আমাদের নিতে হবে, আর অনিন্দনীয় কাব্যমহিমা তাকে দীপ্তিশালী করবে। একদিন বাংলার সংগীতে যখন বড়ো প্রতিভার আবির্ভাব হবে তখন সে বসে বসে পঞ্চদশ শতাব্দীর তানসেনী সংগীতকে ঘন্টার পর ঘণ্টা ধরে প্রতিধ্বনিত করবে না,