পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ved O রবীন্দ্র-রচনাবলী সেখানে বাহিরে যাহা কিছু প্রকাশিত হয় তাহা একেবারেই সম্পূর্ণ। এইজন্য সেখানে গায়কের কণ্ঠস্বরে কোথাও লেশমাত্র দুর্বলতা থাকিলে চলে না। আমাদের দেশে গান সাধাটাই মুখ্য, সেই গানেই আমাদের যতী-কিছু দুরূহতা ; যুরোপে গলা সাধাটাই মুখ্য, সেই গলার স্বরে তাহারা অসাধ্য সাধন করে। আমাদের দেশে যাহারা প্রকৃত শ্রোতা তাহারা গানটাকে শুনিলেই সন্তুষ্ট থাকে, যুরোপে শ্রোতারা গান গাওয়াটাকে শোনে। সেদিন ব্রাইটনে তাই দেখিলাম— সেই গায়িকীটির গান গাওয়া অদ্ভুত, আশ্চর্য। আমার মনে হইল যেন কণ্ঠস্বরে সার্কাসের ঘোড়া হাঁকাইতেছে। কণ্ঠনালীর মধ্যে সুরের লীলা কোথাও কিছুমাত্র বাধা পাইতেছে না। মনে যতই বিস্ময় অনুভব করি।-না কেন, সেদিন গানটা আমার একেবারেই ভালো লাগিল না। বিশেষত, তাহার মধ্যে স্থানে স্থানে পাখির ডাকের নকল ছিল, সে আমার কাছে অত্যন্ত হাস্যজনক মনে হইয়াছিল। মোটের উপর আমার কেবলই মনে হইতে লাগিল মনুষ্যকণ্ঠের প্রকৃতিকে যেন অতিক্রম করা হইতেছে। তাহার পরে পুরুষ গায়কদের গান শুনিয়া আমার আরাম বোধ হইতে লাগিল- বিশেষত ‘টেনর’ গলা যাহাকে বলে সেটা নিতান্ত একটা পথহারা ঝোড়ো হাওয়ার অশরীরী বিলাপের মতো নয়- তাহার মধ্যে নরকণ্ঠের রক্তমাংসের পরিচয় পাওয়া যায়। ইহার পরে গান শুনিতে শুনিতে ও শিখিতে শিখিতে যুরোপীয় সংগীতের রস পাইতে লাগিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমার এই কথা মনে হয় যে, য়ুরোপের গান এবং আমাদের গানের মহল যেন ভিন্ন ; ঠিক এক দরজা দিয়া হািদয়ের একই মহলে যেন তাহারা প্রবেশ করে না : যুরোপের সংগীত যেন মানুষের বাস্তবজীবনের সঙ্গে বিচিত্ৰভাবে জড়িত। তাই দেখিতে পাই সকল রকমেরই ঘটনা ও বর্ণনা আশ্রয় করিয়া য়ুরোপে গানের সুর খাটানো চলে ; আমাদের দিশি সুরে যদি সেরূপ করিতে যাই। তবে অদ্ভুত হইয়া পড়ে, তাহাতে রস থাকে না। আমাদের গান যেন জীবনের প্রতিদিনের বেষ্টন অতিক্রম করিয়া যায়, এইজন্য তােহর মধ্যে এত করুণা এবং বৈরাগ্য ; সে যেন বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবহৃদয়ের একটি অন্তরতর ও অনির্বচনীয় রহস্যের রূপটিকে দেখাইয়া দিবার জন্য নিযুক্ত ; সেই রহস্যলোক বড়ো নিভৃত নির্জন গভীর- সেখানে ভোগীর আরামকুঞ্জ ও ভিক্তের তপোবন রচিত আছে, কিন্তু সেখানে কর্মনিরত সংসারীর জন্য কোনােপ্রকার সুব্যবস্থা নাই। যুরোপীয় সংগীতের মর্মস্থানে আমি প্রবেশ করিতে পারিয়াছি এ কথা বলা আমাকে সাজে না। কিন্তু, বাহির হইতে যতটুকু আমার অধিকার হইয়াছিল তাঁহাতে যুরোপের গান আমার হৃদয়কে এক দিক দিয়া খুবই আকর্ষণ করিত। আমার মনে হইত এ সংগীত রোমান্টিক। রোমান্টিক বলিলে যে ঠিকটি কী বুঝায় তাহা বিশ্লেষণ করিয়া বলা শক্ত। কিন্তু, মোটামুটি বলিতে গেলে, রোমান্টিকের দিকটা বিচিত্রতার দিক, প্রাচুর্যের দিক, তাহা জীবনসমুদ্রের তরঙ্গ-লীলার দিক, তাহা অবিরাম গতিচাঞ্চল্যের উপর আলোকছায়ার দ্বন্দ্বসম্পাতের দিক। আর-একটা দিক আছে যাহা বিজ্ঞার, যাহা আকাশনীলিমার নির্নিমেষত, যাহা সুদূর দিগন্তরেখায় অসীমতার নিস্তব্ধ আভাস। যাহাই হউক, কথাটা পরিষ্কার না হইতে পারে, কিন্তু আমি যখন যুরোপীয় সংগীতের রসভোগ করিয়াছি তখনি বারংবার মনের মধ্যে বলিয়ছি ইহা রোমান্টিক— ইহা মানবজীবনের বিচিত্রতাকে গানের সুরে অনুবাদ করিয়া প্রকাশ করিতেছে। আমাদের সংগীতে কোথাও কোথাও সে চেষ্টা নাই যে তােহা নহে, কিন্তু সে চেষ্টা প্রবল ও সফল হইতে পারে নাই। আমাদের গান ভারতবর্ষের নক্ষত্ৰখচিত নিশীথিনীকে ও নবোন্মেষিত অরুণরাগকে ভাষা দিতেছে ; আমাদের গান ঘনবর্ষার বিশ্বব্যাপী বিরহবেদন ও নববসন্তের বানান্তপ্রসারিত গভীর উন্মাদনার বাক্যবিস্মৃত বিহবলতা।