পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষ্মণ; নহিলে অস্ত্ৰহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে ? কহাে মহারথি, একি মহারথী প্ৰথা ? নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে এ কথা! যদি ইচ্ছাপূর্বক করিয়া থাকেন, তবে কেন করিলেন? এ মহাকাব্যে কি মহান চরিত্র যথেষ্ট আছে? রাবণকে কি স্ত্রীলোক করা হয় নাই? ইন্দ্ৰকে কি ভীরু মনুষ্যরূপে চিত্রিত করা হয় নাই? এ কাব্যের রাম কি একটি কৃপাপাত্র বালক নহেন ? তবে এ মহাকাব্যে এমন কে মহান চরিত্র আছেন, যাহার কাহিনী শুনিতে শুনিতে আমাদের হৃদয় স্তম্ভিত হয়, শরীর কণ্টকিত হয়, মন বিস্ফারিত হইয়া যায়। ইহাতে শয়তানের ন্যায় ভীষণ দুৰ্দম্য মন, ভীষ্মের ন্যায়। উদার বীরত্ব, রামায়ণের লক্ষ্মণের ন্যায় উগ্ৰ জ্বলন্ত মূর্তি, যুধিষ্ঠিরের ন্যায় মহান শাস্তভাব, চিত্রিত হয় নাই। ইহাতে রাবণ প্রথম হইতেই পুত্ৰশোকে কঁদিতেছেন, ইন্দ্ৰ ইন্দ্ৰজিতের ভয়ে কঁাপিতেছেন, রাম বিভীষণের নিকট গিয়া ত্ৰাহি ত্ৰাহি করিতেছেন, ইহা দেখিয়া যে কাহার হাদয় মহান ভাবে বিস্ফারিত হইয়া যায়, জানি না। s W R যখন ইন্দ্ৰজিৎ লক্ষ্মণকে কহিলেন, নিরস্তু যে অরি, নহে রখীকুল প্ৰথা আঘাতিতে তারে। এ বিধি, হে বীরবর, অবিদিত নহে, ক্ষত্ৰ তুমি, তব কাছে;— কী আর কহিব ? ছাড়ে রে কিরাত তারে ? বধিব এখনি, অবোধ তেমনি তোরে! জন্ম রক্ষঃকুলে তোর, ক্ষত্রধর্ম, পাপি, কী হেতু পালিব, তোর সঙ্গে ? মারি অরি, পারি যে কৌশলে!” এ কথা বলিবার জন্য জলদাপ্রতিম স্বনের কোনো আবশ্যক ছিল না। রামায়ণের লক্ষ্মণ একটি উদ্ধত উগ্র-যুবক, অন্যায় তাহার কোনোমতে সহ্য হয় না, তরবারির উপরে সর্বদাই তাহার হস্ত পড়িয়া আছে, মনে যাহা অন্যায় বুঝিবেন মুহুর্তে তাহার প্রতিবিধান করিতে প্ৰস্তুত আছেন, তাহার। আর বিবেচনা করিবেন না, অগ্রপশ্চাৎ করিবেন না, তাহার ফল ভালো হইবে কি মন্দ হইবে তাহা জ্ঞান নাই, অন্যায় হইলে আর রক্ষা নাই। অল্পবয়স্ক বীরের উদ্ধত চঞ্চল হৃদয় রামায়ণে সুন্দরীরূপে চিত্রিত হইয়াছে। যখন দশরথ রামকে বনে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন ও রামও তাঁহাতে সম্মত হইলেন, তখন লক্ষ্মণ যাহা কহিতেছেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া দিলাম, ইহাতে পাঠকেরা কিয়ৎপরিমাণে রামায়ণে বর্ণিত লক্ষ্মণচরিত্র বুঝিতে পরিবেন। ‘রাম এইরূপ কহিলে মহাবীর লক্ষ্মণ সহসা দুঃখ ও হর্ষের মধ্যগত হইয়া অবনতমুখে কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিলেন এবং ললাটপট্টে ভূকুটি বন্ধনপূর্বক বিলমধ্যস্থ ভুজঙ্গের ন্যায় ক্ৰোধাভরে ঘন ঘন নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তাহার বদনমণ্ডল নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য হইয়া উঠিল এবং কুপিত সিংহের মুখের ন্যায় অতি ভীষণ বোধ হইতে লাগিল। অনন্তর হস্তী যেমন ट२ ১. হেমচন্দ্ৰ ভট্টাচার্য -কৃত রামায়ণ হইতে উদধূত।