পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত S\ed তাহারা আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল। ...সেই ঘূণ্য হতভাগ্যের মৃত্যু-আঘাত পাইতে এখনো বাকি আছে- অবশেষে সে স্কন্ধে ভীষণ আঘাত পাইল- তাহার মাংসপেশীসমূহ বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল— অস্থির সন্ধিমূল বিভিন্ন হইল। সমরে বােউলফের জয় হইল।” বিচ্ছিন্ন হস্ত-পদ গ্রেন্ডেল হ্রদে গিয়া লুকাইল। “সেই হ্রদের তরঙ্গ তাহার রক্তে ফুটিতে লাগিল। হ্রদের জল তাহার শোণিতের সহিত মিশিয়া উষ্ণ হইয়া উঠিল। রক্ত-বিবৰ্ণ জলে শোণিতের বুদবুদ উঠিতে লাগিল।” সেইখানেই তাহার মৃত্যু হইল। কিন্তু গ্রেন্ডেলের মাতা, তাহার পুত্রের মতো যাহার অতি শীতল সলিলের ভীষণ স্থানে বাস নির্দিষ্ট ছিল’। সে একদিন রাত্ৰে আসিয়া আর-একজন যোদ্ধাকে বিনাশ করিল। বােউলফ পুনরায় তাহাকে বধ করিতে চলিলেন। একটি পর্বতের নিকট এক ভীষণ গহ্বর ছিল- সে গহুর নেকড়িয়া ব্যাস্ত্রদের আবাস স্থান। পর্বতের অন্ধকারে ভূমির নিম্ন দিয়া এক নদী বহিয়া যাইতেছে। বৃক্ষসমূহ শিকড় দিয়া সেই নদী আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। রাত্রে সেখানে গেলে দেখা যায় সে স্রোতের উপর আগুন জুলিতেছে। সে অরণ্যে কেহ নেকড়িয়া ব্যাঘ্র দ্বারা আক্রান্ত হইলে বরং তীরে দাঁড়াইয়া মরিয়া যাইবে তবুও সে স্রোতে লুকাইতে সাহস পাইবে না। অদ্ভুতাকৃতি পিশাচ (Dragon) ও সর্পসমূহ সেই স্রোতে ভাসিতেছে। বােউলফ সেই তরঙ্গে ডুব দিলেন; বাধা-বিঘ্ন অতিক্ৰম করিয়া সেই রাক্ষসীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। সে তাহাকে মুষ্টিতে বদ্ধ করিয়া তাহার আবাস স্থানে লইয়া গেল। সেখানে এক বিবৰ্ণ আলোক জুলিতেছিল। দেখিলেন। অবশেষে তাহাকে বধ করিলেন। তঁহার মৃত্যু-ঘটনা নিম্নলিখিতরূপে কথিত আছে : পঞ্চাশ বৎসর তিনি রাজত্ব করিলে পর এক ড্রাগন (Dragon) আসিয়া ‘অগ্নি-তরঙ্গে” মনুষ্য ও গৃহ নষ্ট করিতে লাগিল। বোউলফ এক লৌহ-চর্ম নির্মাণ করিলেন। এবং তাঁহাই পরিধান করিয়া একাকী যুদ্ধ করিতে গেলেন। ‘নৃপতির এমন উদ্ধত গর্ব ছিল যে, সেই পক্ষবান রাক্ষসের সহিত যুদ্ধে অধিক সঙ্গী ও সৈন্য লইয়া যাইতে চাহিলেন না।” কিন্তু তথাপি কেমন বিষগ্ন হইয়া অনিচ্ছার সহিত গেলেন, কেননা এইবার তাহার অদূদ্ষ্টে মৃত্যু আছে। সেই রাক্ষস অগ্নি উদগার করিতে লাগিল। তাহার শরীরে অন্ত্র বিদ্ধ হইল না। রাজা সেই অগ্নির মধ্যে পতিত হইয়া অতিশয় যন্ত্রণা পাইতে লাগিলেন। উইগলাফ ব্যতীত তাহার অন্য সমস্ত সহচর বনে পলায়ন করিল। উইগলাফ অগ্নিমধ্যে প্রবেশ করিল, এবং তাঁহাদের উভয়ের খড়গাঘাতে সেই ড্রাগন বিচ্ছিন্ন-শরীর ও বিনষ্ট হইল। কিন্তু রাজার ক্ষতস্থান ফুলিয়া উঠিল ও জুলিতে লাগিল, “তিনি দেখিলেন তাহার বক্ষের মধ্যে বিষ ফুটিতেছে।” তিনি মৃত্যুকালে বলিলেন, ‘পঞ্চাশ বৎসর আমি এই-সকল প্ৰজাদিগকে পালন করিয়াছি। এমন কোনো রাজা ছিল না যে আমাকে ভয় দেখাইতে বা আমার নিকট সৈন্য পাঠাইতে সাহস করিত। আমার যাহা-কিছু ছিল তাহা ভালোরূপ রক্ষা করিয়াছি, কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করি নাই, অন্যায় শপথ করি নাই। যদিও আমি মৃত্যু-আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছি, এই সকল কারণে তথাপি আমার আনন্দ হইতেছে। প্রিয় উইগলাফ ! এখনি যাও, ওই শ্বেত-প্রস্তর-শালা (দৈত্যের আবাস) অনুসন্ধান করিয়া দেখো, গুপ্তধন পাইবে। আমার জীবন পূর্বে আমার প্রজাদের জন্য এই যে ধন পাইয়াছি ইহার নিমিত্ত দেবতার নিকট ঋণী রহিলাম।” এই কাব্যের কবিতা যতই অসম্পূর্ণ হউক, ইহার নায়ক যে অতি মহান তাহাতে আর সন্দেহ নাই। ইহার চরিত্রে প্রতিপদে পৌরুষ প্ৰকাশ পাইতেছে। পরের উপকারের জন্য নিজের প্রাণ দিতে ইনি কখনো সংকুচিত হন নাই। সেই সময়কার সমাজের অসভ্য অবস্থায় এরূপ চরিত্র যে চিত্রিত হইতে পরিবে ইহা একপ্রকার অসম্ভব বলিয়া বোধ হয়। অ্যাংলো স্যাকসন কবিতা হৃদয়ের কথা মাত্র, আর কিছুই নহে। ইহাতে চিন্তার কোনো সংস্রব নাই। ইহার কবিতা কতকগুলি ভাঙা ভাঙা কথার সমষ্টিমাত্র- ছন্দও তেমনি ভাঙা ভাঙা, ঠিক যেন হৃদয়ের পূর্ণ উচ্ছাসের সময় সকল কথা ভালো করিয়া বাহির হইতেছে না। সৈন্যদল !