পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য S °ላó দান্তে তাহার নয়। বৎসর বয়স হইতেই বিয়াত্ৰিচেকে ভালোবাসিতে আরম্ভ করেন; কিন্তু তঁহার প্ৰেম সাধারণ ভালোবাসা নামে অভিহিত হইতে পারে না। বিয়াত্ৰিচের সহিত তাহার প্রেমের আদান-প্ৰদান হয় নাই, নেত্ৰে নেত্ৰে নীরব প্রেমের উত্তর-প্রত্যুত্তর হয় নাই। অতিদূর সাক্ষাৎ— দূর আলাপ ভিন্ন বিয়াত্ৰিচের সহিত র্তাহার সাক্ষাৎ ও আলাপ হয় নাই। অতি দূরস্থ নমস্কারে আপনাকে দেবানুগৃহীত মনে করিতেন। যে সভায় বিয়াত্রিচে আছেন, সে সভায় গেলে তিনি কেমন অভিভূত হইয়া পড়িতেন, তিনি কথা কহিতে পারিতেন না, তাহার শরীর কঁাপিতে থাকিত! বিয়াত্ৰিচেকে তিনি তঁহার প্রেমের কাহিনী বলেন নাই, বলিতে সাহস করেন নাই, বা বলিবার আবশ্যক বোধ করেন নাই। তিনি আপনার প্রেমের স্বপ্নেই আপনি মগ্ন থাকিতেন, তাহার প্রেম জাগ্রত রাখিবার জন্য বিয়াত্ৰিচের প্রতিদান আবশ্যক ছিল না। তঁহার কাব্য পড়িলে প্রত্যাশা করিবার ইচ্ছা মনে এক মুহুৰ্তও স্থান পায় না। যদিও ভিটা নুওভা” কাব্যের নায়িকাই বিয়াত্ৰিচে, কিন্তু পাঠকেরা বিয়াত্ৰিচের মুখ হইতে একটি কথাও শুনিতে পান নাই, বিয়াত্তি সর্বদাই তঁহাদের নিকট হইতে দূরে রহিয়াছেন। রূপক প্রভৃতির দ্বারা বিয়াত্রিচেকে দাস্তে এমন একটি মেঘময় অস্ফুট আবরণে আবৃত করিয়া রাখিয়াছেন যে, পাঠকের চক্ষে সেই অস্ফুট মূর্তি অতি পবিত্র বলিয়া প্রতিভাত হয়। দান্তে র্তাহার প্রেমাদ্র হৃদয়ে মনে করিতেন, “যে ব্যক্তিই বিয়াত্ৰিচের নিকট আসিত তাঁহারই হৃদয়ে এমন গভীর ভক্তির উদ্ৰেক হইত যে, তাহার মুখের দিকে নেত্ৰ তুলিতে তাহার সাহস হইত না।” দান্তে বলেন, “যখন মানুষ্যেরা তাহার দিকে চাহিত তখনি তাহারা কেবল একটি মাধুর্য ও মহত্ত অনুভব করিত।” দান্তে ভক্তির চক্ষে দেখিতেন, সমস্ত পৃথিবী বিয়াত্ৰিচের পূজা করিতেছে, দেবতারা তঁহাকে আপনাদের মধ্যে আনিবার জন্য প্রার্থনা করিতেছেন। দাস্তের ‘ডিভাইনা কমেডিয়া’র নরকের দ্বার-রক্ষকেরা বিয়াত্ৰিচের নাম শুনিয়াই অমনি সসন্ত্ৰমে দ্বার খুলিয়া দিতেছে- দেবতারা বিয়াত্ৰিচের নাম শুনিয়া আমনি স্বৰ্গযাত্রীদ্বয়কে সহৰ্ষে আহবান করিতেছেন। বিয়াত্ৰিচের মৃত্যুর পর দান্তে অশ্রুপূর্ণ নয়নে দেখিলেন, যেন সমস্ত নগরীই রোদন করিতেছে। বিয়াত্ৰিচের সহিত প্ৰথম সাক্ষাৎ বর্ণনাই ভিটা নুওভা’র আরম্ভ— “যখন আমার জীবনের আরম্ভ হইতে নয় বার মাত্র সূর্য র্তাহার কক্ষ প্ৰদক্ষিণ করিয়াছে, এমন সময়ে আমার হৃদয়ের মহান মহিলা আমার চক্ষের সমক্ষে আবির্ভূত হইলেন।... তখন র্তাহার জীবনের আরম্ভ মাত্র এবং আমার বয়স নবম বৎসর অতিক্ৰম করিয়াছে। তাহার শরীরে সুন্দর লোহিত বর্ণের পরিচ্ছদ, একটি কটিবন্ধ ও বাল্যবয়সের উপযুক্ত কতকগুলি অলংকার। সত্য বলিতেছি। তাঁহাকে দেখিয়া সেই মুহুর্তেই আমার হৃদয়ের অতি নিভৃত নিলয়স্থিত মর্ম পর্যন্ত । কঁপিয়া উঠিল, এবং তাহার প্রভাব আমার শরীরের শিরায় শিরায় প্রকাশিত হইল। সে (মৰ্ম) কঁাপিতে কঁাপিতে এই কথাগুলি বলিল ওই দেখো, আমা অপেক্ষা সরলতর দেবতা আমার উপর আধিপত্য করিতে আসিয়াছেন;... সেই সময় হইতে প্ৰেম আমার হৃদয়-রাজ্যের অধিপতি হইল।... দেবতাদিগের মধ্যে কনিষ্ঠ দেবতাটিকে (বিয়াত্ৰিচেকে) দেখিবার জন্য প্রেমের দ্বারা উত্তেজিত হইয়া বাল্যকালে কতবার তাহার অন্বেষণে ফিরিয়াছি। সে এমন প্ৰশংসনীয়; তাহার ব্যবহার এমন মহৎ যে কবি হােমারের উক্তি তাহার প্রতি প্রয়োগ করা যাইতে পারে— অর্থাৎ ‘তাঁহাকে দেখিয়া মনে হয় সে দেবতাদের মধ্যে জন্মলাভ করিয়াছে, মানুষের মধ্যে নহে। বিয়াত্ৰিচের পিতা একটি ভোজ দেন, সেই ভোজে দান্তের পিতা তঁহার পুত্রকে সঙ্গে লইয়া যান; সেই সভাতেই দান্তের সহিত বিয়াত্ৰিচের উক্ত প্রথম সাক্ষাৎ হয়। দ্বিতীয় সাক্ষাৎ এইরূপে বৰ্ণিত হয় : উপরি-উক্ত মহান মহিলার সহিত সাক্ষাতের পর নয় বৎসর পূর্ণ হইয়াছে এমন সময়ে নিষ্কলঙ্ক-শুভ্ৰ-বসনা, সখীদ্বয়-পরিবেষ্টিত সেই বিস্ময়জনক মহিলা আর-একবার আমার সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন। তিনি রাজপথ দিয়া যাইবার সময় আমি যেখানে সসন্ত্ৰমে স্তম্ভিত হইয়া