পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য SSV আসিল। সে মৃদু হাস্যে নমস্কার করিয়া কহিল— ‘দাসী অসুস্থা, শুইতে গিয়াছে, আপনাদের কী প্রয়োজন, আমাকে অনুমতি করুন!” এই রমণীকে দেখিয়া গেটের হৃদয় অতিশয় মুগ্ধ হইল— তিনি তাহাকে অতিশয় সুন্দরী দেখিলেন- তাহার বসন, ভূষণ, গঠন, তাহার টুপিটি পর্যন্ত তাহার বড়ো ভালো লাগিল। গেটে এই প্রথম প্রেমে পড়িলেন। গেটে তাহার বাড়িতে যাইবার কোনো ছুতা না পাইয়া গির্জায় গিয়া উপাসনার সময় তাহাকেই দেখিতেন। কিন্তু তথাপি উপাসনা ভঙ্গ হইলে পর তাহার সহিত কথা কহিতে বা তাহার সঙ্গ লইতে সাহস করিতেন না! এবং অন্য প্রেমিকদের ন্যায় দূর হইতে তাহার নমস্কার পাইয়াই পরিতৃপ্ত হইতেন- পরিতৃপ্ত না হউন সুখী হইতেন। এই রমণীর নাম গ্রেশেন। যে বাড়িতে তাহাকে প্রথমে দেখিয়াছিলেন সেই বাড়িতে কোনো উপায়ে পুনরায় তাহার সহিত একবার মিলন ধার্যকরিয়া সাক্ষাৎ করিলেন। যেন একজন রমণী একজন যুবাকে লিখিতেছে, এইরূপ ভাবের একখানি প্রেমের পত্র তাহাকে পড়িয়া শুনাইলেন। সে শুনিয়া কহিল— ‘সুন্দর হইয়াছে বটে। কিন্তু এমন সুন্দর চিঠি যদি সত্য সত্য লেখা হইত, তবে বেশ হইত।” গেটে কহিলেন, “বাস্তবিক সে যুবা যদি এই চিঠিখানি পাইয়া থাকে। আর যে মহিলাকে সে প্ৰাণাপেক্ষা ভালোবাসে সেও তাহাকে এইরূপ ভালোবাসে, তাহা হইলে সে কী সুখীই হইত।” গ্রেশেন কহিল, হাঁ কথাটা শুনিতে যেমনই হউক।-- নিতান্ত অসম্ভব নহে।” গেটেকহিলেন, “আচ্ছা মনে করো, একজন যে তোমাকে চেনে, মাথায় করিয়া পূজা করে, ভালোবাসে, সে যদি তোমার সম্মুখে এই চিঠিখানি দেয়, তবে তুমি কী করা?” গ্রেশেন ঈষৎ হাসিয়া, একটু ভাবিয়া চিঠিটা লইল ও তাহার নীচে আপনার নাম সই করিয়া দিল। গেটে আনন্দে উন্মত্ত হইয়া তাহাকে আলিঙ্গন করিতে গেলেন। সে কহিল— ‘না— চুম্বন করিয়ো না- উহা তো সচরাচর হইয়া থাকে, ভালোবাসিতে হয় তো ভালোই বাসো।” প্রেমিকের এরূপ সাহসিকতা আমাদের কাছে কেমন কেমন লাগে বটে— কিন্তু যুরোপীয়দের চক্ষে এরূপ দৃশ্য ও তাহাদের কর্ণে এরূপ কথাবার্তা চিরাভ্যস্ত। গেটের জীবনচরিত পড়বার সময় অবশ্য কতকটা তাহাদের দেশীয় আচার-ব্যবহারের অভ্যস্তরে প্রবেশ করিতে হইবে। পরে গেটে সেই চিঠিটি লইয়া কহিলেন, “এ চিঠি আমার কাছেই রহিল— সমস্ত গোল চুকিয়া গেল, তুমি আমাকে বঁাচাইয়াছ!” গ্রেশেন কহিল, আর কেহ না আসিতে আসিতে এই বেলা তুমি চলিয়া যাও।” গেটে কোনোমতে তাহাকে ছাড়িয়া যাইতে পারিলেন না। কিন্তু সে মেহের সহিত র্তাহার দুই হস্ত ধরিয়া এমন দয়াদ্রভাবে কহিল যে, গেটের চক্ষে জল আসিল, গোটে কল্পনায় দেখিলেন তাহারও চক্ষে যেন জল আসিয়াছে। অবশেষে তাহার হস্ত চুম্বন করিয়া চলিয়া আসিলেন। গেটে কয়েক সপ্তাহ, ধরিয়া প্ৰত্যহ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেন; নানাবিধ ভোজে, নানা প্ৰমোদ স্থানে তিনি তাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেন। গেটে একদিন গ্রেশেনদের বাড়িতে রাত্রি পর্যন্ত আছেন, সহসা তাহার মনে পড়িল তিনি তাহাদের দ্বারের চাবি আনিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। কহিলেন- , র্তাহার বাড়ি ফিরিয়া যাওয়া অনর্থক, অনেক গোলমাল না করিয়া বাড়িতে প্ৰবেশ করা অসম্ভব। তাহারা সকলে কহিল- ‘বেশ তো- এসো, আমরা সকলে মিলিয়া আজ এইখানেই রাত্রি জাগরণ করিয়া কাটাইয়া দিই।” গেটের তাহাতে কোনো আপত্তি ছিল না। এমন-কি, আমাদের এক-এক বার সন্দেহ হয়, তিনি ইচ্ছা করিয়াই বা চাবি আনিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। কফি পান করিয়া সকলে রাত্রি জাগরণের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আস্তে আস্তে তাস খেলা বন্ধ হইল। গল্প ক্রমে ক্ৰমে থামিয়া আসিল, গৃহের কত্রী তাহার চৌকির উপর ঘুমাইতে আরম্ভ করিলেন, অভ্যাগতগণ ঢুলিতে লাগিলেন। গেটে এবং গ্রেশেন জানালার এক ধারে বসিয়া অতি মৃদুস্বরে কথাবার্তা কহিতেছিলেন, ক্ৰমে গ্রেশেনেরও ঘুম আসিল, তাহার মস্তকটি সে ধীরে ধীরে গেটের কাধে রাখিল, ক্রমে ঘুমাইয়া পড়িল। গোটেও অল্পে অল্পে ঘুমাইয়া পড়িলেন। এইরূপে সে রাত্ৰি কাটিয়া গেল। কিন্তু তিনি যে এইরূপ নীচ শ্রেণীর লোকদিগের সহিত মিশেন ইহা তাহার পিতার কানে গেল। তিনি মহা ক্রুদ্ধ হইলেন এবং ওই বিষয়ের