পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VONOV রবীন্দ্ররচনাবলী করিতে লাগিলেন। কিন্তু, হায়, আমাদের পক্ষে সেই পুরাতন জ্যোতিই নূতন, এই নুতন কালিমাই পুরাতন; সেই সনাতন বিশুদ্ধ সত্য শাস্ত্রের মধ্যে আছে, আর এই সমস্ত অধুনাতন লোকাচার আমাদের ঘরে বাহিরে, আমাদের চিন্তায় কাৰ্যে, আমাদের সুখে দুঃখে শত সহস্ৰ চিহ্ন রাখিয়াছেচক্ষু উমীলন করিলেই তাহাকে আমরা চতুর্দিকে দেখিতে পাই, শাস্ত্ৰ উদঘাটন না করিলে সনাতন সত্যের সাক্ষাৎ পাই না। অতএব, হে রামমোহন রায়, তুমি যে মুক্তা আহরণ করিয়াছ তাহা শ্রেয় হইতে পারে, কিন্তু যে শুক্তি যুক্তি-অন্ত্রে বিদীর্ণ করিয়া ফেলিয়া দিতেছ। তাঁহাই আমাদের প্রেয়, আমাদের পরিচিত; আমরা মুক্তাকে মুখে বহুমূল্য বলিয়া সম্মান করিতে সম্মত আছি, কিন্তু শুক্তিখণ্ডকেই হািদয়ের মধ্যে বধিয়া রাখিব। তাহা হউক, সত্যকেও সময়ের অপেক্ষা করিতে হয়। কিন্তু, একবার যখন সে প্রকাশ পাইয়াছে তখন তাহার সহিতও আমাদের ক্রমশ পরিচয় হইবে। সত্যের পথ। যদি বাধাগ্ৰস্ত না হয় তবে সত্যকে আমরা সম্পূর্ণরূপে পরীক্ষা করিয়া চিনিয়া লইতে পারি না; সন্দেহের দ্বারা পীড়িত নিষ্পীড়িত করিয়া। তবে আমরা সত্যের অজেয় বল, আটল স্থায়িতা বুঝিতে পারি। যে প্রিয় পুরাতন মিথ্যা আমাদের গৃহে আমাদের হৃদয়ে এতকাল সত্যের ছদ্মবেশে বিরাজ করিয়া আসিয়াছে তাহাকে কি আমরা এক মুহুর্তের মধ্যে অকাতরে বিদায় দিতে পারি? সত্য যখন আপনি কল্যাণময় কঠিন হস্তে তাহাকে আমাদের বক্ষ হইতে একেবারে কড়িয়া ছিনিয়া লইয়া যাইবে তখন তাহার জন্য আমাদের হৃদয়ের শোণিতপাত এবং অজস্র অশ্রু বর্ষণ করিতে হইবে। যে ব্যক্তি তাহার পুরাতন প্ৰেয় বস্তুকে আপনি শিথিল মুষ্টি হইতে অতি সহজেই ছাড়িয়া দিতে পারে সে লোক নূতন শ্রেয়কে তেমন সবলভাবে একান্তমনে ধারণ করিতে পারে না। পুরাতনের জন্য শোক যেখানে মৃদু, নূতনের জন্য আনন্দ সেখানে স্নান। অবসন্ন রজনীর বিদায়-শিশিরাশ্রজলের উপরেই প্ৰভাতের আনন্দ-অভু্যদয় নির্মল উজ্জ্বল সুন্দর রূপে উদ্ভাসিত হইয়া উঠে। প্রথমে সকলেই বলিব, না না, ইহাকে চাহি না, ইহাকে চিনি না, ইহাকে দূর করিয়া দাও; তাহার পর একদিন বলিব, এসো এসো হে সর্বশ্রেষ্ঠ, এসো হে হৃদয়ের মহারাজ, এসো হে আত্মার জাগরণ, তোমার অভাবেই আমরা এতদিন জীবন্মৃত হইয়া ছিলাম। এসো গো নূতন জীবন। এসো গো কঠোর নিঠুর নীরব, এসো গো ভীষণ শোভন।। এসো গো অশ্রুসলিলসিক্ত, এসো গো ভূষণবিহীন রিক্ত, এসো গো চিত্তপােবন। থাক বীণাবেণু, মালতীমালিকা, পূৰ্ণিমানিশি, মায়াকুহেলিকাএসো গো প্রখর হােমানলশিখ হৃদয়শোণিতপ্রাশন । এসো গো পরমদূঃখিনিলয়, মোহ-অন্ধুর করো গো বিলয়, এসো সংগ্রাম, এসো মহাজয়, এসো গো মরণ সাধন । প্ৰথমে প্রত্যাখান করিয়াছিলাম বলিয়াই, যখন আবাহন করিব তখন একান্তমনে সমস্ত হৃদয়ের সঙ্গে করিব।-- প্ৰবল দ্বন্দ্বের পর পরাজয় স্বীকার করিয়া যখন আত্মসমৰ্পণ করিব তখন সম্পূর্ণরূপেই করিব, তখন আর ফিরিবার পথ রাখিব না।