পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VV8 রবীন্দ্র-রচনাবলী তুমি কোনোমতে তা বিশ্বাস কর না, তুমি বলে, “না, না, তা কি হয় ? লোকটা কি একেবারে খাঁটি মিথ্যে কথা বলতে পারে?” কী আশ্চর্য! হরিহরের মুখে তুমি যখন রামধনের নিন্দের কথা শুনেছিলে, তখন তো তুমি প্রশংসনীয় উদারতার সঙ্গে বল নি যে, “না, না, তা কি হয়। সে লোকটা কি এমন কাজ করতে পারে?” একটা নিন্দা তুমি অতি সহজে গলাধঃকরণ করলে, কিন্তু আর-একটা সেই শ্রেণীর নিন্দেই কেন তোমার গলায় হঠাৎ বাধল? এর কারণ অবশ্য সকলেই বুঝতে পারছেন। তিনি পরম আনন্দে একটি সুস্বাদ নিন্দা উপভোগ করছিলেন, আর তুমি কি না। আর-একটি নীরস নিন্দা তার হাতে দিয়ে সেটি তার মুখ থেকে কেড়ে নিতে চাও? যে নিন্দুকের মুখ থেকে তিনি অমৃত পান করেন, তাকে তুমি আর যা খুশি বলে নিন্দে করো, কিন্তু মিথ্যেবাদী বলে খবরদার নিন্দে কোরো না, তা হলে তুমিই মিথ্যেবাদী হয়ে দাঁড়াবে। বিশ্বাস-পরায়ণতা মনের সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থা। যাঁরা পরনিন্দা শুনলে অতি সহজেই তা বিশ্বাস করেন, তাদের হয়তো তুমি বিশ্বাস-পরায়ণ বলবে। আমি তো ঠিক তার উল্টো বলি। যেমন তুমি যখন বল, আমি চার দিক অন্ধকার দেখছি, তখন তার অর্থ বোঝায়, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি নে, অর্থাৎ অন্ধকার দেখা, কিছু না-দেখার ভাষান্তর মাত্ৰ, তেমনি নিন্দা-বিশ্বাসিত, অবিশ্বাসিতার অন্য একটি নাম। তুমি দেখতে পাবে, সন্দিগ্ধ ও কুটিল হৃদয়েরাই নিন্দা নিয়ে লেন-দেনা করে থাকেন। তুমি যথার্থ সরল ও অসন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তির কাছে কারও নিন্দা উত্থাপন করো, তিনি বলে উঠবেন, না, না, এমনও কি মানুষে করতে পারে।” মানুষের চরিত্রের উপর তার এত বিশ্বাস যে, তিনি, কেহ যে খারাপ কাজ করেছে, তা শীঘ্ৰ বিশ্বাস করতে পারেন না। মনে করো, তোমার এক পরিচিত ব্যক্তি অত্যন্ত ধাৰ্মিক, তাকে তুমি প্রত্যহ দুই সন্ধে দেবপূজা করতে দেখ, আমি তোমাকে একদিন কানে কানে ফুসফুস করে বললেম যে, চক্রবতী মশায় বৃহস্পতিবারে গোমাংস খেয়েছেন, অমনি তুমি তা বিশ্বাস করলে; তুমি কতদূর সন্দিগ্ধহৃদয় বলে। দেখি! তুমি প্রত্যহ নিজের চক্ষে তার ধাৰ্মিকতার প্রমাণ পােচ্ছ, আরেকদিন একটা কানে কানে কথা শুনেই সে-সমস্ত তুমি অবিশ্বাস করলে ? চণ্ডীমণ্ডপে গুটিপাঁচেক বৃদ্ধ গৃহস্বামী বসে ধূমসেবন করছেন, চাণক্যের শ্লোক পাঠ করে ও বয়ঃপ্রাপ্তি অবধি চণ্ডীমণ্ডপের তাম্রকুটধুমােচ্ছন্ন ও নস্যগন্ধী পর্য-চৰ্চা শুনে সংসারের বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা অসাধারণ পঙ্কত প্ৰাপ্ত হয়েছে; রামশংকর খুড়ো তাদের এসে বললেন যে, মণ্ডলদের বাড়ির ছোটাে বউ সমাজ-বিরুদ্ধ কাজ করেছে, তারা অতি অল্প পরিশ্রমে সমস্ত সিদ্ধান্ত করে মহা বিজ্ঞভাবে বললেন যে, “কিছু আশ্চর্য নয়, কারণ, “বিশ্বাসং নৈব কর্তব্যং শ্ৰীষু রাজকুলেষু চ”। তাই তো বলি, নিন্দা বিশ্বাস করা সন্দিগ্ধ হৃদয়ের লক্ষণ। তবে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা দূর অপেক্ষা আশু, অনুপস্থিত অপেক্ষা উপস্থিত, ও নিজের চোখের দেখা অপেক্ষা পরের মুখের কথা অধিক বিশ্বাস করেন। এখন তুমি তাকে একটি খবর দেও, তা বিশ্বাস করতে র্তার যত পরিশ্রম ও সময় ব্যয় হবে, দুঘণ্টা পরে আর-এক জন ঠিক তার বিপরীত খবর দিলে, তা বিশ্বাস করতে তার তার চেয়ে কিছু অধিক হবে না। এমন লোকের শিশু-প্রকৃতির একটা ঘোরতর ভ্রমের ফল। এ দলের সম্বন্ধে আমার অধিক কিছু বক্তব্য নেই। নিন্দা অবিশ্বাস করবার ক্টোক অনেকটা শিক্ষা ও অভ্যাস -সাপেক্ষ। এ বিষয়ে বিশেষ অভ্যাস ও বিবেচনা আবশ্যক। যে নিন্দা শুনলে তোমার মনে কষ্ট হয়, তা তুমি না বিশ্বাস করতেও পাের, কিংবা যে নিন্দায় তোমার কষ্ট বা সুখ কিছুই না জন্মায়, তা তুমি বিশেষ প্রমাণ না পেলে অবিশ্বাস করতে পার, কিন্তু স্বাৰ্থজড়িত কতকগুলি বিশেষ কারণে যে নিন্দা শুনলে তোমার আমোদ জন্মাবার সম্ভাবনা, তা বিশেষ প্রমাণ না পেয়ে বিশ্বাস না করা শিক্ষিত মনের লক্ষণ। আর-এক অবস্থায় আমরা নিন্দা অতি সহজে বিশ্বাস করি। আমরা একজন লোককে খারাপ বলে জানি, তার নামে একটা নিন্দ শুনাবামাত্রেই আমরা অনায়াসে বিশ্বাস করি, আমরা মনে করি এটা কিছুই অসম্ভব নয়। সুতরাং আমরা তার আর প্রমাণ জিজ্ঞাসা করি নে কিন্তু শিক্ষিতমনা ব্যক্তিরা তখন বলেন যে, “সমস্ত সম্ভব ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে না।” একটা জিনিস