পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

評電荷 Nao হইয়া যায়; ইহারা বঙ্গসমাজের কানে তুলা দিয়া রাখিতে চান পাছে সে গান শুনিয়া ফেলে ও তাহার প্রাণ কোমল হইয়া যায়, পাছে সে উপন্যাস পড়ে ও তাহার চিত্ত দুর্বল হইয়া পড়ে, পাছে । সে নাট্যাভিনয় শোনে ও তাহার হাদয় আৰ্দ্ৰ হইয়া যায়। দিনরাত্রি কেবল বঙ্গসমাজকে ঘিরিয়া বুসিয়া তাহার কানের কাছে তুরী ভেরী জগন্ধম্প বাজাও, যেখানে যে আছ ঢাকঢোল গলায় বাঁধে, ঢুলিতে দেখিলেই পরস্পর পরস্পরকে খোঁচা মারো এবং ‘উঠ উঠ’, ‘জাগো জাগো’ বলিয়া অস্থির করিয়া তোলো। কিন্তু এই বীরপুরুষেরা বড়ো মনের আনন্দে আছেন। একখানা ছাতা ঘাড়ে করিয়া এই সকল সরু সরু ব্যক্তিরা কেবলই চার দিকে ছটফট করিয়া বেড়াইতেছেন, বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নাই, লক্ষ্য নাই, কেবল একটা গোলমাল চলিতেছে, মনে মনে অত্যন্ত স্মৃৰ্তি যে ভারি একটা কাজ করিতেছি। আর যত প্রকার কাজ আছে তাহা নিতান্ত অবহেলার চক্ষে দেখেন, যাহারা অন্যান্য কাজে মগ্ন রহিয়াছে তাহাদিগকে কৃপাপাত্র জ্ঞান করেন, ঈষৎ হাস্য করিয়া মনে করেন, আর সকলে কী ছেলেখেলাই করিতেছে! কাজ যা একমাত্র তিনিই করিতেছেন, কেননা তিনি যে কী করিতেছেন নিজেই তাহা পরিষ্কাররাপে জানেন না, কেবল এক প্রকার অস্পষ্ট ধারণা আছে যে, খুব একটা কী কাজ করিয়া বেড়াইতেছি। সত্য বটে, এক প্রকার ব্যস্ত কোমরবাঁধা মুষ্টিবদ্ধ উদগ্রভাব সর্বদাই দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু কেন যে এ ভাব তাহা তিনিও জানেন না, আমিও জানি না। কী যেন একটা ঘোরতর কারখানা বাধিয়াছে, কী যেন একটা সর্বনাশের উদ্যোগ হইতেছে, কেবল তিনি জাগ্ৰত সতর্ক আছেন বলিয়াই কোনো দুর্ঘটনা ঘটিতেছে না। শ্রাবণের রাত্রে বজ্রবিদ্যুৎ বর্ষণের সময় ব্যাঙের দল নিতান্ত ব্যস্তভাবে সমস্ত রাত্রি জাগিয়া জগতের কানের কাছে অনবরত মকমক করিতে থাকে, তাহারাও বোধ করি মনে করে, ভাগ্যে তাহারা ছিল ও প্ৰাণপণে সমস্ত রাত্রি চিৎকার করিয়াছে, জগতে তাই আজ প্ৰলয় হইতে পারিল না। আমাদের বীরপুরুষেরাও মনে করেন, আজি এই দুর্যোগের রাত্রে ভারতবর্ষের ভার বিশেষরূপে তাহাদেরই হস্তে সমাপিত হইয়াছে, এইজন্য উদ্দেশ্যহীনের ন্যায় অবিশ্রান্ত হো হাে করিয়া হুটপাট করিয়া বেড়াইতেছেন ও মনে করিতেছেন জগতের অত্যন্ত উপকার হইতেছে। কাজেই ইহাদের বুক ক্ৰমেই ফুলিতে থাকে ও প্ৰাণ ক্রমেই সংকীর্ণ হইতে থাকে, বঙ্গসমাজ বা বঙ্গসাহিত্যের সর্বাঙ্গীণ বিকাশকে অত্যন্ত ভয় করেন। ইহারা চান বঙ্গসাহিত্য কেবলমাত্র দাঁত ও নখের চর্চা করিতে থাকুক আর কিছু নয়। ক্ষমতাভেদেও ও অবস্থাভেদে যে প্রত্যেকে স্ব স্ব উপযোগী কার্যে হইবে ও এইরূপে সমাজের অন্তনিহিত বিচিত্ৰ শক্তি চারি দিক হইতে বিকশিত হইয়া তাহা তাঁহাদের অভিপ্রেত নহে। আজ কয়েক বৎসর ধরিয়া এই শ্রেণীর কতকগুলি সংকীর্ণদৃষ্টি সমালোচক কবিদিগকে কবিত্ব শিখাইয়া আসিতেছেন ও অবিরত বীররস। ফরমাস করিতেছেন এবং অবশিষ্ট আটটি রসের মধ্যে কোনো একটি রসের ছিটাফোটা দেখিবামাত্র ননীর পুতুলি বঙ্গসমাজের স্বাস্থ্যভঙ্গের ভয়ে শশব্যস্ত হইয়া উঠিতেছেন! তাহার কতকটা ফল ফলিয়াছে, - বীররসটা ফ্যাশান হইয়া পড়িয়াছে। গদ্য লেখক ও পদ্য লেখকগণ পালোয়ান সমালোচকদিগের চিৎকার বন্ধ করিয়া দিবার জন্য তাঁহাদের মুখে বীররসের টুকরা ফেলিয়া দিতেছেন। সকলেই বলিতেছে, উঠ, জাগো; বাংলায় ইংরাজিতে গদ্যে, পদ্যে, মিত্ৰাক্ষরে, অমিত্ৰাক্ষরে, হাটে ঘাটে, নাট্যশালায়, সভায়, ছেলে মেয়ে বুড়ো সকলেই বলিতেছে, উঠ, জাগো। সকলেই যে অকপট হৃদয়ে বলিতেছে বা কেহই যে বুঝিয়া বলিতেছে তাহা নহে। সকলেই বলিতেছে, আজ উনবিংশ শতাব্দী’, উনবিংশ শতাব্দীটা যেন বঙ্গসমাজের বাবা স্বয়ং রোজগার করিয়া আনিয়াছে। উনবিংশ শতাব্দী’ নামক একটা অনুবাদিত শব্দ বাঙালির মুখে শুনিলে অত্যন্ত হাসি পায়। যে বাঙালি দুই দিন বিলাতে থাকিয়া বিলাতকে home বলেন তিনিও ইহা অপেক্ষা হাস্যজনক কথা বলেন না!. উনবিংশ শতাব্দী আমাদের কে? আঠারোটি শতাব্দী যাহাদিগকে ক্ৰমান্বয়ে মানুষ করিয়া