পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8) R রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বাধীন ভাবগুলিকে ক্রীতদাসের মতো কেনাবেচা করিবার প্রথা তাহরাই অত্যন্ত প্রচলিত করিয়াছেন। এইরূপে শতসহস্ৰ ভাব প্রত্যহই নিতান্ত হেয় হইয়া পড়িতেছে। স্বাধীন অবস্থায় তাহারা যেরাপ গৌরবের সহিত কাজ করিতে পারে, দাসত্বের জোর-জবরদস্তিতে ও অপমানে তাহারা সেরাপ পারে না ও এইরূপে ইংরাজিতে যাহাকে cant বলে সেই cant-এর সৃষ্ঠি হয়। ভাব যখন স্বাধীনতা হারায়, দোকান্দারেরা যখন খরিদারের আবশ্যক বিবেচনা করিয়া তাহাকে শৃঙ্খলিত করিয়া হাটে বিক্রয় করে তখন তাঁহাইcant হইয়া পড়ে। য়ুরোপের বুদ্ধি ও ধর্মীরাজ্যের সকল বিভাগেই cant নামক একদল ভাবের শূদ্ৰজাতি সৃজিত হইতেছে। যুরোপের চিন্তাশীল <fest Vatics (se (R, RJ2. Theological cant, Sociological cant, Political cant-এর দলপুষ্টি হইতেছে। আমার বিশ্বাস তাহার কারণ- সেখানকার বহুবিস্তৃত সাময়িক সাহিত্য ভাবের দাস-ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছে। কেননা, পূর্বে যাহা বলা হইয়াছে তাহাতেই বুঝাইতেছে- স্বাধীন ভাবেরই অবস্থান্তর cant। যদি কোনো সহৃদয় ব্যক্তি cant-এর দাসত্বশৃঙ্খল খুলিয়া দিয়া পুনশ্চ তাহাকে মুক্ত করিয়া দেন, তবে সেই আবার স্বাধীন ভাব হইয়া ওঠে- এবং তাহাকেই সকলে বহুমান করিয়া পূজা করিতে থাকে। সত্যকথা মহৎকথাও দোকানদারীর অনুরোধে প্রচার করিলে অনিষ্টজনক হইয়া ওঠে। যথার্থ হৃদয় হইতে উচ্ছসিত হইয়া উঠিলে যে কথা দেবতার সিংহাসন টলাইতে পারিত, সেই কথাটাই কি না ডাকমাসুল সমেত সাড়ে তিন টাকা দরে মাস হিসাবে বঁটিয়া-বঁটিয়া ছেড়া কাগজে মুড়িয়া বাড়ি-বাড়ি পাঠান। যাহা সহজ প্রকৃতির কাজ তাহারও ভার নাকি আবার কেহ গ্ৰহণ করিতে পারে! কোনো দোকানদার বলুক দেখি সে মাসে মাসে এক-একটা ভাগীরথী ছাড়িবে, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় লাটাই বাঁধিয়া ধূমকেতু উড়াইবে বা প্রতি শনিবারে ময়দানে একটা করিয়া ভূমিকম্পের নােচ দেখাইবে। সে হাঁকার জল ফিরাইতে, ঘুড়ি উড়াইতে ও বাঁদর নাচাইতে পারে বলিয়া যে অস্নান বদনে এমনতরো একটা গুরুতর কার্য নিয়মিতরাপে সম্পন্ন করিবার ভার গ্রহণ করিতে চাহে, ইহা তাহার নিতান্ত স্পর্ধার কথা। আজকাল খাতায় টুকিয়া রাখিতে হয়- অমুক দিন ঠিক অমুক সময়ে পকেট দেশের লোকের কুসংস্কার কিছুতেই বরদাস্ত করিতে পারিব না ও তাঁহাই লইয়া ঠিক তিনপোয়াআন্দাজ রাগ ও একপোয়া-আন্দাজ দুঃখ করিব; বন্ধু যখন নিমন্ত্ৰণ করিতে আসেন— উনত্রিশে চৈত্র ১১টার সময় আমার ওখানে আহার করিতে আসিয়ে, তখন আমাকে বলিতে হয়- না ভাই তাহ পারিব না। কারণ ত্ৰিশে চৈত্র আমার কাগজ বাহির হইবে, অতএব কাল ঠিক এগারোটার সময় দেশের অনৈক্য দেখিয়া আমার হদয় ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া উঠিবে এবং ভীষ্ম দ্রোণ ও অশ্বথামাকে স্মরণ করিয়া আমাকে অতিশয় শোকাতুর হইতে হইবে।” যুরোপে লেখক বিস্তর আছে, সেখানে তবু এতটা হানি হয় না, কিন্তু হানি কিছু হয়ই। আর, আমাদের দেশে লেখক নাই বলিলেও হয়, তবুও তো এতগুলো কাগজ চলিতেছে। কেমন করিয়া চলে? লেখার ভান করিয়া চলে। সহৃদয় লোকদের হৃদয়ে অন্তঃপুরবাসী পবিত্র ভাবগুলিকে সাহিত্যসমাজের অনার্যেরা যখনি ইচ্ছা অসংকোচে তাহদের কঠিন মলিন হন্তে স্পর্শ করিয়া । অশুচি করিয়া তুলিতেছে। এই সকল লেচ্ছেরা মহৎবংশোদ্ভব কুলীন ভাবগুলির জাত মারিতেছে। কঠিন প্ৰায়শ্চিত্ত করাইয়া। তবে তাহাদিগকে সমাজে তুলিতে হয়। কারণ, সকল বিষয়েই অধিকারী ও অনধিকারী আছে। লেখার অধিকারী কে? না, যে ভাবে, যে অনুভব করে। ভাবগুলি যাহার পরিবারভুক্ত লোক। যে-খুশি-সেই কোম্পানির কাছ হইতে লাইসেন্স লইয়া ভাবের কারবার করিতে পারে না। সেরাপ অবস্থা মগের মুলুকেই শোভা পায় সাহিত্যের রাম-রাজত্বে শোভা পায় না। কিন্তু আমাদের কর্তমান সাহিত্যের অরাজকতার মধ্যে কি তাহাঁই। হইতেছে না! না হওয়াই যে আশ্চৰ্য। কারণ এত কাগজ হইয়াছে যে, তাহার লেখার জন্য যাকে-তাকে ধরিয়া বেড়াইতে হয়- নিতান্ত অর্বািচীন হইতে ভীমরতিগ্ৰস্ত পর্যন্ত কাহাকেও ছাড়িতে পারা যায় না। মনে করো,