পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমাজ 8 Sq ছোটাে কোনটা বড়ো তাহা স্থির করিতে পারে কে! ইতিহাসবিখ্যাত একটা কুহেলিকাময় দিগগজ ব্যাপারই যে বড়ো, আর দ্বারের নিকটস্থ একটি রক্তমাংসময় দৃষ্টিগোচর অসম্পূর্ণতাই যে সামান্য তাহা কে জানে! কিসের হইতে যে কী হয়, কোন ক্ষুদ্র বীজ হইতে যে কোন বৃহৎ বৃক্ষ হয় তাহা জানি না, এই পর্যন্ত জানি সহজ হৃদয়ের প্রেম হইতে কাজ করিলে কিছুই আর ভাবিতে হয় না। কারণ, সহজ ভাবের গুণ এই, সে আর হিসাবের অপেক্ষা রাখে না। তাহার। আপনার মধ্যেই আপনার নবী, আপনার দলিল। তাহকে আর চৌদ্দ অক্ষর গণিয়া ছন্দ রচনা করিতে হয় না, সুতরাং তাহার আর ছন্দোভঙ্গ হয় না; আর যাহাকে গণনা করিতে হয়, তাহার গণনায় ভুল হইতেই বা আটক কী! সে বড়োকে ছোটো মন করিতে পারে, ছোটোকে বড়ো মনে করিতে pi | আমাদের স্বদেশহিতৈষীদের কোনো দোষ দেওয়া যায় না। তঁহাদের এক হাতে ঢাল এক হাতে তলোয়ার- তাহদের হাতের অপেক্ষা হাতিয়ার বেশি হইয়া পড়িয়াছে, এইজন্য কাজকর্ম সমস্তই একেবারে স্থগিত রাখিতে হইয়াছে। এবং এই অবসরে দুশো পাঁচশো উধৰ্বপুচ্ছ জিহবা এককালে ছাড়া পাইয়া দেশের লোকের কানের মাথাটি মুড়াইয়া ভক্ষণ করিতেছে। এই সকল ভীমাৰ্জ্জুনের প্রপৌত্ৰগণের, স্বদেশের উপর প্রেম এত অত্যন্ত বেশি যে স্বদেশের ‘লোকের’ উপর প্ৰেম আর বড়ো অবশিষ্ট থাকে না। এই কারণে, ইহারা স্বদেশের হিতসাধনে অত্যন্ত উন্মুখ, সুতরাং স্বদেশীর হিতসাধনে সময় পান না। ব্যাপারটা যে কীরূপ হইতেছে তাহা বলা বাহুল্য। ঘোড়াটা না খাইতে পাইয়া মরিতেছে ও সকলে মিলিয়া একটা ঘোড়ার ডিম লইয়া তা” দিতেছেন, দেশে-বিদেশে রাষ্ট্র তাহা হইতে এক জোড়া পক্ষিরাজের জন্ম হইবে। যে ব্যক্তি দয়া প্রচার করিয়া বেড়ায় অথচ ভিক্ষুককে এক মুঠ ভিক্ষা দেয় না, তাহার প্রতি আমার কেমন স্বভাবতই অবিশ্বাস জন্মে। সে কথায় বড়ো বড়ো চেক কাটে, কেননা কোনো ব্যাঙ্কেই তাহার এক পয়সা জমা নাই। পুরাকালে কাঠবিড়ালীদের মধ্যে একজন জ্ঞানী জন্মিয়াছিলেন। তিনি কুলবৃক্ষে বাস করিতেন। দর্শনশাস্ত্রে যখন তাহার অত্যন্ত বুৎপত্তি জন্মিল, তখন তিনিই প্ৰথম আবিষ্কার করেন যে, একটি শ্বেত পদার্থের অপেক্ষা শ্বেতবর্ণ ব্যাপক, একটি কুলফলের অপেক্ষা কুলফলত্ব বৃহৎ, কারণ তাহা চরাচরস্থ যাবৎ কুলফলের আধার। এই মহৎতত্ত্ব আবিষ্কারের পর হইতে কুলের প্রতি তাহার এমনি ঘূণা জন্মিল যে, তিনি কুল ভক্ষণ একেবারে পরিত্যাগ করিলেন- কুলত্বের চারা কীরূপে আবাদ করা যাইতে পারে ইহারই অন্বেষণে র্তাহার অবশিষ্ট জীবন ক্ষেপণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু এই গুরুতর গবেষণার প্রভাবে তাহার অবশিষ্ট জীবন এমন সংক্ষিপ্ত হইয়া আসিল যে, কুলত্বের চারা আজ পর্যন্ত বাহির হইল না। আজিও সেই কুলগাছ তাহার সমাধির উপরে মুনমেন্টম্বরূপ দাঁড়াইয়া আছে, এবং ভক্ত কাঠবিড়ালীগণ আজিও দূর-দূরান্তর হইতে আসিয়া তাহাকে স্মরণপূর্বক সেই বৃক্ষ হইতে পেট ভরিয়া কুল খাইয়া যায়। বিষ্ণুশৰ্মার অপ্রকাশিত পুঁথিতে এই গল্পটি পাঠ করিয়া আমার মনে হইল, হিতবাদ, প্রত্যক্ষবাদ এবং অন্যান্য বাদানুবাদের ন্যায়। উক্ত কুলফলত্ববাদও সমাজে বহুল পরিমাণে প্রচলিত আছে। কিন্তু এই বাদকে যে কোনো অনুষ্ঠান আশ্রয় করে সে উক্ত পূজনীয় কাঠবিড়ালী মহাশয়ের ন্যায় বেশিদিন বঁাচে না। আমাদের দেশহিতৈবিতাও বোধ করি নিজের মহত্ত্বের অভিমানে স্কুল খাদ্য ভক্ষণ করা নিতান্ত হেয় জ্ঞান করিয়া হাওয়া ও বাম্পের মতো খোরাকে জীবনধারণ করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছেন। এই নিমিত্ত দেখা যায় আমাদের এই দেশহিতৈষিতা পদার্থটা কামারের হাপরের ন্যায় মুহুর্তের মধ্যে ফুলিয়া ঢাক হইয়া উঠিতেছে এবং পরের মুহুর্তেই টুপসিয়া শুকনা চামচিকার আকার ধারণ করিতেছে। ইহার উত্তরোত্তর উন্নতি নাই। ইহা হাওয়ার : গতিকে হঠাৎ ফাপিয়া উঠে, আবার একটু আঘাত পাইলেই আওয়াজ করিয়া ফাটিয়া যায়, তার পরে আর সে আওয়াজও করে না, ফোলেও না। কিন্তু, খোরাক বদল করা যায় যদি, যদি ইহা ত্বগিন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য স্কুল পদার্থের প্রতি দক্ষিণহস্ত চালনা করে, তবে আর এমনতরো আকস্মিক