পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5a 86 তাহাকে সযত্নে সকাতরে রক্ষা করিতে হয়; তাহা আঘাতে ক্লিষ্ট হয়, উত্তাপে স্নান হইয়া যায়। কিন্তু Ideality-র পক্ষে তাহার অসীম প্রভাব, সমস্ত বলবুদ্ধি অবহেলে তাহার শরণাপন্ন হইয়া পড়ে। পুরুষ যখন রমণীকে ভালোবাসে তখন সেই ভালোবাসার মধ্যে সে সম্পূর্ণ বিরাম পায় না; যদিও তাহার ভালোবাসার মধ্যে একটি অনির্বচনীয় সুখ থাকে তথাপি কী একটা আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ সুগভীর বিষাদ ছায়ার ন্যায় তাহার অনুবতী হইয়া থাকে। কারণ সমুদয় যথার্থ সৌন্দর্যের মধ্যে একটি চিরনিলীন আকাঙ্ক্ষা সর্বদা বিরাজ করিতে থাকে। যেমন ভালো গান শুনিলে প্ৰাণ উদাস হইয়া যায়, প্রকৃতির উদার সৌন্দর্য অনুভৱ করিলে হৃদয়ের মধ্যে ব্যাকুলতা জন্মে। বস্তুর মধ্যেই সৌন্দর্যের সমাপ্তি নহে, সে যেন আপন আশ্রয়স্থলকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করিয়া একটি অসীমতাকে ব্যাপ্ত করিয়া থাকে। আমরা বস্তুকে গ্ৰহণ করি, স্পর্শ করি, ভ্ৰাণ করি, কিন্তু সেই অসীমতাকে আয়ত্ত করিতে পারি না। এইজন্য আমাদের কর্মের চঞ্চলতা দূর হয় না। এইজন্য আমরা ভ্রমবশত সহস্ৰ বস্তুকে স্পর্শ করিয়া দেখিতে চাহি এবং সেই স্পর্শকেই সৌন্দর্যের ভোগ বলিয়া ভ্ৰম হয়, এবং এইরূপে ভ্ৰান্ত লোকের মন হইতে সৌন্দর্যের আধ্যাত্মিকতার প্রতি বিশ্বাস নিতান্ত শারীরিকতার মধ্যে হারাইয়া যাইতে পারে। এইজন্য পুরুষের প্রেমের চাঞ্চল্য ও ভোগপ্রিয়তা লোকবিখ্যাত। কিন্তু উচ্চশ্রেণীর পদার্থ মাত্রেরই মধ্যে পরিপূর্ণতা (Perfection) অতি বিরল। একটি গাছের মধ্যে তাহার অধিকাংশ ফুল ও পাতা তাহার। আপনার মধ্যে সম্পূর্ণতা লাভ করিয়া সুন্দর হইয়া উঠে। কুগ্ৰী বেল জুই চাপা অতি দুর্লভ। কিন্তু মানুষের মধ্যে শারীরিক সর্বতোমুখী সম্পূর্ণতা বিরল। সেইরূপ, আমার বিশ্বাস, সৌন্দর্যপ্রিয়তা হইতে যে প্রেমের উৎপত্তি তাহা উন্নতশ্রেণীয় প্রেম। এইজন্য সাধারণত সেই প্রেমের চরম বিকাশ দেখা যায় না, এবং অধিকাংশ স্থলে তাহার বিকার লক্ষিত হয়। আমি অনুভব করি পুরুষের সম্পূর্ণ প্রেমের সহিত স্ত্রীলোকের প্রেমের তুলনা হয় না। পুরুষ যখন তাহার সমস্ত বলবুদ্ধি বৃহত্ত কুসুমপেলাব সৌন্দর্যের নিকট বিসর্জন দেয় তখন সেই প্রেমের মধ্যে একটি সুমহৎ রহস্য উদ্ভাবিত হইতে থাকে। প্রেম রমণীর পক্ষে বাস্তবিক আশ্রয়স্থল- এইজন্য সে তাহার মধ্যে পরিতৃপ্ত থাকে- ক্ষমতাকে সর্বতোভাবে কায়মনোবাক্যে অবলম্বন করিয়া সে পরিপূর্ণ বিশ্রাম লাভ করে। সৌন্দর্য তাহার হৃদয়কে চঞ্চল ও বিক্ষিপ্ত করে না। সে যাহা পাইয়াছে তাহার মধ্যেই তাহার আকাঙক্ষার অবসান। রমণী। এই কারণে বিশেষ Practical। সে কিছু অসমাপ্ত দেখিতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত গল্পের সমস্ত হিসাব না চুকিয়া যায় ততক্ষণ সে জিজ্ঞাসা করে ‘তার পর। শুদ্ধ কাল্পনিকতার প্রতি তাহার এক প্রকার বিদ্বেষ আছে। আমার সামান্য অভিজ্ঞতায় এই দেখিয়াছি রমণীরা প্রকৃত সাহিত্যের যথার্থ রসংগ্ৰাহী ও সমালোচক হইতে পারে না। রমণীর প্রেমের মধ্যে পরিতৃপ্তি আছে, বিশ্বাস আছে, নিষ্ঠা আছে, কিন্তু পুরুষের প্রেমের মধ্যে যে একটি চির অতৃপ্তিপূর্ণ অনির্বচনীয় সুখ আছে তাহা বােধ করি খুব অল্প রমণী উপভোগ করিয়াছে। সেই প্রেমে যেন মানবাত্মার অন্তর্নিহিত গভীর অমরতা হইতে এক অপূর্ব রাগিণীময় গান বাহিরের সৌন্দর্যময়ী অসীমতার দিকে কল্পিত হেমশিখার ন্যায় সর্বদা উখিত হইতে থাকে। প্রেমের অবস্থায় যত কবিতা এবং গান তাহা]। হৃদয় হইতেই বাহির হইয়াছে। সৌন্দর্যপ্রেমের মধ্যে সেই চিরাচঞ্চলা শক্তি আছে যাহা হইতে কবিতা ও গান বাহির হইতে পারে— গভীর সুখ গভীর দুঃখ গভীর তৃপ্তির সহিত গভীর কামনার যোগে মানব হৃদয়ের এই সকল কাতর গান জাগিয়া উঠে- প্রেমিক গাহিয়া উঠে “জনম অবধি হম রূপ নেহারানু নয়ন না তিরপিত ভেল, লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখানু, তবু হিয়ে জুড়ন না গেল।” কেহ কাহাকেও সত্য সত্যই লাখ যুগ হৃদয়ে হৃদয়ে রাখে নাই, কিন্তু উদ্দাম মুহুর্তের মধ্যে সেই লক্ষ যুগ রহিয়াছে। মনের মধ্যে অনুভব হয় যে, য়ে সৌন্দর্যের জন্যে হৃদয় কাতর লক্ষ যুগেও সে সৌন্দর্যের তৃপ্তি নাই কারণ তাহা অসীম। :