পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

干電寶 8や2° প্ৰস্তুত নহে তাহদের রচিত একটা আন্দোলন দেখিলে প্ৰথমেই সন্দেহ জন্মে যে, ইহার সহিত যতটুকু অহংকার-আস্ফালনের যোগ ততটুকুই তাহাদের লক্ষ্য ও অবলম্বনস্থল, প্রকৃত আত্মবিসর্জন অনেক দূরে আছে। শ্ৰীযুক্ত বাবু কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় তাহার ‘গীতসূত্রসার’ নামক অতি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের এক স্থলে লিখিয়াছেন, “ভারতীয় লোকের প্রাচীন বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও আদর আছে বটে। কিন্তু তাহা ইতিহাস-প্রিয়তাজনিত নহে, তাহা আলস্য ও নিশ্চেষ্টতার ফল।” এ কথা আমার সত্য বলিয়া বোধ হয়। মনে আছে বাল্যকালে যখন ন্যাশনাল ছিলাম তখন অর্ধশ্ৰষ্ঠত ইতিহাসের অনতিস্ফুট আলোকে অহরহ প্ৰাচীন আৰ্যকীর্তি সম্বন্ধে জাগ্ৰতস্বপ্ন দেখিয়া চরম আনন্দ লাভ করিতাম। ইংরাজের উপর তখন আমাদের কী আক্রোশই ছিল! তাহার কারণ আছে। যখন কাহারো মনে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, তিনি তাহার প্রতিবেশীর সমকক্ষ সমযোগ্য লোক, অথচ কাজকর্মে কিছুতেই তাহার প্রমাণ হইতেছে না, তখন উক্ত প্রতিবেশীর বাপান্ত না করিলে তাহার। মন শাড়িলাভ করে না। আমরা ন্যাশনাল অবস্থায় ঘরে বসিয়া এবং সভায় দাঁড়াইয়া নিৰ্ম্মফল আক্ৰোশে ইংরাজ জাতির বাপান্ত করিতাম; বলিতাম, আমাদের পূর্বপুরুষ যখন ইন্দ্রপ্রন্থে রাজত্ব করিতেছেন তখন ইংরাজের পূর্বপুরুষ গায়ে রঙ মাখিয়া কঁচা মাংস খাইয়া বনে বনে নেকড়িয়া বাঘের সহিত লড়াই করিয়া বেড়াইতেছে। আবার বিদ্রুপ করিয়া এমনও বলিতাম- ডারুয়িন ইংরাজ তাই আদিম পূর্বপুরুষদিগকে বানর বলিতে বাধ্য হইয়াছেন। ইংরাজের লালমূর্তি ও পাঠকদিগের মনে সবিশেষ কৌতুক উদ্দীপন করিতাম। ইংরাজি বই পড়িতাম, ইংরাজি কাগজ লিখিতাম, ইংরাজি খাদ্য একটু বিশেষ ভালোবাসিতাম, ইংরাজি জিনিসপত্র বিশেষ আদরের সহিত ব্যবহার করিতাম, মূর্তিমান ইংরাজ দেখিলে মনে বিশেষ সম্রামের উদয় হইত, অথচ তাহাতে করিয়া ইংরাজের প্রতি রাগ বাড়িত বৈ কমিত না। দেশে ডাকাতি হয় না বলিয়া আক্ষেপ সংবাদ পাইলে ইংরাজ শাসনের শৈথিল্যের প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট হইত। এই ন্যাশনাল উদ্দীপনা এককালে অত্যন্ত টনটনে হইয়া উঠিয়াছিল এখন ইহা chronic ভাব ধারণ করাতে ইহার প্রকাশ্য দাবাদবানি অনেকটা কমিয়াছে। অনেকটা সংহত হইয়া এখন ইহা Political agitation vario o RTCR এই আজিটেশনের মধ্যে একটা ভাব এই লক্ষ হয় যে, আমাদের নিজের কিছুই করিবার নাই, কেবল পশ্চাৎ হইতে মাঝে মাঝে গবর্নমেন্টের কোর্তা ধরিয়া যথাসাধ্য টান দেওয়া আবশ্যক। আমরা বড়ো, তবু আমাদিগকে ভারি ছোটাে দেখাইতেছে, সে কেবল তোমরা চাপিয়া রাখিয়াছ বলিয়া। স্ক্রিপ্রংয়ের পুতুল বাক্সর মধ্যে চাপা থাকে। ডালা খুলিবামাত্র এক লম্ফে নিজমূর্তি ধারণ করে। আমাদেরও সেই অবস্থা। কিছুই করিবার নাই- তোমরা বাহির হইতে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের টিপন দিয়া ডালা খুলিয়া দাও আমরা ক্যাচু শব্দ করিয়া গাত্ৰোখান করি। আবার এইসঙ্গে যাহারা আমাদের সাহিত্যের নেতা তাহারা সম্প্রতি এক বিশেষ ভােব ধারণ করিয়াছেন। তাহারা বলেন, আমাদের মতো এমন সমাজ আর পৃথিবীতে কোথাও নাই। হিন্দু বিবাহ আধ্যাত্মিক এবং বাল্যবিবাহ ব্যতীত তাহার সেই পরম আধ্যাত্মিকতা রক্ষা হয় না, আবার একান্নবর্তী প্রথা না থাকিলে উক্ত বিবাহ টেকে না- এবং যেহেতুক হিন্দু বিবাহ আধ্যাত্মিক, বিধবা বিবাহ অসম্ভব, এদিকে জাতিভেদ প্ৰথা এই অপূর্ব আধ্যাত্মিক সমাজের শৃঙ্খলা, শ্ৰমবিভাগও সর্বাঙ্গীণ উন্নতির কারণ। অতএব আমাদের সমাজ একেবারে সর্বাঙ্গসম্পন্ন। যুরোপীয় সমাজ ইন্দ্ৰিয়সুখের উপরেই গঠিত, এইজন্য তাহার মধ্যে আদ্যোপােন্ত উচ্ছঙ্খলতা আবার বলেন, আমাদের দেশের প্রচলিত উপধর্ম মানবজাতির একমাত্র অবলম্বনীয়, উহা অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ ধর্ম মানব-বুদ্ধির অতীত।