পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6?ዒ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বিবিধ প্ৰসঙ্গ ২ এক “আমি” মাঝে আসাতেই প্রকৃতিতে কত গোলযোগ ঘটিয়াছে দেখো। আমি'-কে যেমনি লোপ করিয়া ফেলিবে অমনি প্রকৃতির পূর্ব-পশ্চিমে, অতীত-ভবিষ্যতে, অন্তর-বাহিরে গলাগলি এক হইয়া যাইবে। “আমি” আসাতেই প্রকৃতির মধ্যে এত গৃহবিচ্ছেদ ঘটিয়াছে। কাহাকেও বা আমি আমার পশ্চাতে ফেলিয়াছি, কাহাকেও বা আমার সম্মুখে ধরিয়াছি, কাহাকেও বা আমার দক্ষিণে বসাইয়াছি, কাহাকেও বা আমার বামে রাখিয়াছি। মনে করিতেছি আমার পিঠের দিক এবং আমার পেটের দিক চিরকাল স্বভাবতই স্বতন্ত্র, কারণ, জগতের আর সমস্তের প্রতি আমার অবিশ্বাস হইতে পারে। কিন্তু আমার পিঠ ও ‘আমার পেট” এ আমি কিছুতেই ভুলিতে পারি না। “আমি কে যে যত দূরে সরাইয়াছে জগতের মধ্যে সে ততই সাম্য দেখিয়াছে। যেখানে যত বিবাদ, যত অনৈক্য, যত বিশৃঙ্খলা, “আমিটাই সকল নষ্টের গোড়া, যত প্ৰেম, যত সম্ভাব, যত শান্তি, আমার বিলোপই তাহার কারণ। R উদরের ভিতরকার একটা অংশই যে কেবল পাকযন্ত্র তাহা নহে, আমাদের মন ইন্দ্ৰিয় প্রভৃতি যাহা-কিছু আছে সমস্তই আমাদের পাকযন্ত্র। ইহারা সমস্ত জগৎকে আমাদের উপযোগী করিয়া বানাইয়া লয়। আমাদের যাহা যতটুক যেরূপ আকারে আবশ্যক, ইহাদের সাহায্যে আমরা কেবল তাহাঁই দেখি, তাহাই শুনি, তাহাঁই পাই, তাহাঁই ভাবি। অসীম জগৎ আমাদের হাত এড়াইয়া কোথায় বিরাজ করিতেছে! আমাদের যে জগৎদৃশ্য, জগৎজ্ঞান, তাহা, আমাদের ভুক্ত জগৎ, পরিপাকপ্ৰাপ্ত জগতের বিকার, তাহ আমাদের উপযোগী রক্ত মাত্র, আমাদের ইন্দ্ৰিয় মনের কারখানায় প্রস্তুত হইয়া আমাদের ইন্দ্ৰিয় মনের মধ্যেই প্রবাহিত হইতেছে। তাহা প্রকৃত জগৎ নয়, অসীম জগৎ নাহে। VO আমরা সকলে বাতায়নের পাশে বসিয়া আছি। আমরা বাতায়নের ভিতর হইতে দেখি, বাতায়নের বাহিরে গিয়া দেখিতে পাই না। এইজন্য নানা লোক নানা রকম দেখে। কেহ এপাশ দেখে কেহ ও-পাশ দেখে, কাহারো দক্ষিণে জানলা কাহারো উত্তরে জানলা। এই আশপাশ দেখিয়া, খানিকটা ভুল দেখিয়া, খানিকটা না দেখিয়া যত আমাদের ভালোবাসা ঘূণা, যত আমাদের তর্কবিতর্ক। একেকটি মানুষ একেকটি খড়খড়ি খুলিয়া বসিয়া আছি, কেহ-বা হাসিতেছি। কেহ বা নিশ্বাস ফেলিতেছি। জানলার ভিতরকার ওই মুখগুলি কেহ যদি আঁকিতে পারিত ! পৃথিবীর রাস্তার দুই ধারে ওই সকল অন্তঃপুরবাসী মুখের কতই ভাব, কতই ভঙ্গি! সবাই ছবির মতো বসিয়া কতেই ছবি দেখিতেছে! 8 “সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর।’ কারণ অনেক সত্য কথা কে বলিতে পারে! স্কুল কারাগারের ফুটাকাটা দিয়া সত্যের দুই-একটা রশ্মিরেখা শুভলগ্নে দৈবাৎ দেখিতে পাই। একটুখানি সত্যের চতুর্দিকে পুীভূত অন্ধকার থাকিয়া যায়। সংশয় নিশীথের একটি ছিদ্রের মধ্য দিয়া বিশ্বাসকে তারার মতো দেখিতে পাওয়া যায়। যে ব্যক্তি মনে করে সত্যকে ফলাও করিয়া তুলিতে হইবে- তাহাকে বৃহৎ করিয়া একটা বিস্তুত তত্ৰেয় মতো শাস্ত্রের মতো গড়িয়া তুলিতে হইবে- প্রলোভনে এবং দায়ে পড়িয়া সে ব্যক্তি একটি সত্যের সহিত অনেক মিথ্যা মিশাল দেয়। সে আপনার কাছে আপনি প্ৰবঞ্চিত হয়। সত্য হীরার মতো একটুখানি পাওয়া যায়, কিন্তু যা পাই তাই ভালো। কত মূল্যবান সত্যের কণিকা সঙ্গদোষে মারা পড়িয়াছে।