পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(SO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী । সভ্যতা-বৃদ্ধিসহকারে আমাদিগকে অনেক প্রবৃত্তি দমন করিয়া রাখিতে হয়, সুতরাং খেলাচ্ছলে তাহাদের নিবৃত্তি সাধন করিতে হয়। অসভ্য অবস্থায় শুদ্ধমাত্র গীেরবলাভের জন্য যুদ্ধ এই প্রবৃত্তির উত্তেজনায়। সভ্য অবস্থায় নানা প্ৰণালী বাহিয়া এই প্রবৃত্তি আপন শক্তি-উচ্ছাস নিঃশেষিত প্রতিযোগিতায় এবং বাকি নানাবিধ খেলায়। কাব্য লিখিয়া, কাব্য পড়িয়া, অভিনয় দেখিয়া ও করিয়া নানা প্রবৃত্তির অলক্ষিত চরিতার্থতা সাধন হয়। সত্যকার কাজে এত অধিক উত্তেজনা, তাহার সহিত স্বার্থের এত যোগ, তাহতে এত । প্রাণপণ কঠিন চেষ্টার উদ্রেক হয় যে শুদ্ধমাত্র প্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির সুখ তাহাতে লাভ করা যায় না। বিশেষত তাহাতে আমাদের স্বাধীনতা নষ্ট করে। কার্যের কঠিন শৃঙ্খলে একেবারে বন্ধ হইয়া পড়িতে হয়। খেলার মধ্যেও নিয়ম আছে নহিলে বাধা-অতিক্রমণের স্বাভাবিক সুখ হইতে বঞ্চিত হইতে হয়- কিন্তু সে নিয়মের বাধার মধ্যে কেবল ততটুকু দুঃখ আছে যতটুকু না থাকিলে সুখ নিজীবী হইয়া পড়ে। নিয়মকে নিয়ম অথচ তাহার ভার কিছুই নাই। অত্যাবশ্যকের মধ্যে স্বাধীনতার একান্ত পরাভবদুঃখ অনুভব করিতে হয়, খেলায় তাহা হইতে অব্যাহতি পাওয়া যায়। অতএব দেখা যাইতেছে কাজের ভান করিয়া শারীরিক মানসিক নানাবিধ শক্তিচালনা করা খেলা। কিন্তু ইহাতেও কথাটা সম্পূর্ণ হয় না। প্রবঞ্চনা করাকে খেলা বলে না। অনেকে মিথ্যা নিন্দা রটাইয়া সুখ পায়, কিন্তু তাহাকে খেলা বলিলে চলে না। খেলার মধ্যে প্রকাশ্য ভান থাকা চাই। আপনা-আপনির মধ্যে বোঝাপড়া করিয়া প্রবঞ্চনা। আমাদের একটা অংশ ভুলিতেছে এবং আরেকটা অংশ ভুলিতেছে না। এমনি একটা ব্যাপার। আমরা যদি আপনাকে ও অন্যকে বা কেবল আপনাকে বা কেবল অন্যকে সম্পূর্ণ প্ৰবঞ্চনা করি তাহা হইলে আর খেলা হয় না! অতএব “কাজের ভানই খেলা বটে কিন্তু এমনি বঁাচাইয়া চলিতে হইবে যে বেশি কাজ ও না হয় বেশি “ভান”ও না হয়। সর্বস্ব অথবা বিস্তর টাকা পণ রাখিয়া জুয়াখেলা খেলাকে ছাড়াইয়া উঠিয়াছে। লাভ-স্পাহা ও প্রতিযোগিতা প্রবৃত্তিকে খেলার দ্বারা চরিতাৰ্থ করিতে গেলে অল্প পয়সাকে বেশি পয়সা মনে করিয়া লইতে হয়- নতুবা খেলার বিশুদ্ধতা রক্ষা হয় না; স্বার্থের সহিত জড়িত হইলে খেলার লঘুতা দূর হয়, সে আমাদের প্রাণটা যেন চাপিয়া ধরে।— অপরপক্ষে Flintationকে খেলা বলা যাইতে পারে। নিরুদ্যম প্রেমের প্রবৃত্তিকে খেলাচ্ছলে চরিতার্থ করিবার জন্য যদি উভয়পক্ষের মধ্যে মনে মনে বোঝাপড়া থাকে। তবে তাহা খেলা বটে- কিন্তু আত্মপ্ৰবঞ্চনা বা পরস্পরকে প্রবঞ্চনা করিলে তাহা আর খেলা থাকে না। রীতিমতো প্ৰবঞ্চনা করিতে গেলে খেলার লঘুতা চলিয়া যায়- কারণ, খেলায় দুইপক্ষ কিয়ৎপরিমাণে আপনাকে ধরা দেয়, এইজন্য ভান করা গুরুতর চেষ্টসাধ্য বা অধিক চিন্তার কারণ হয় না।-- তাহাতে আমাদের ধর্মবুদ্ধি পীড়িত হয় না এবং লোকসমাজের নিন্দা সহ্য করিতে হয় নাসমস্ত ফলাফল অল্পেই চুকিয়া যায়। নিয়মবন্ধন, কর্মফল, স্বার্থের প্রবল আকর্ষণ। এইগুলো যথাসাধ্য বাদ দিয়া সুদ্ধ শরীর- হৃদয়-মনের অতিরিক্ত উদ্যমকে খাটাইয়া আনন্দ লাভ করা খেলার উদ্দেশ্য। খেলা। অতএব Political Agitation-এর সঙ্গে খেলার তুলনা খাটে কি না ভাবিয়া দেখিতে হয়। আমরা কি আপনাকে ও পরকে ভুলাইতে চেষ্টা করিতেছি না? পরিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক S. So Srira